ঢাকার মিরপুর, বাসাবো, বনশ্রীসহ আরো বেশ কয়েকটি এলাকায় গেলেই দেখা যায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে বেশ কয়েকটি অলিগলি বাঁশ দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে। যার বেশিরভাগ হচ্ছে কোন বিজ্ঞানসম্মত উপায় না মেনেই। এতে করোনাভাইরাস ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না, উল্টো মানুষের দুর্ভোগ বাড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকার ভেতরে এই লকডাউন সর্বপ্রথম হয়েছিল মিরপুরের উত্তর টোলারবাগ এলাকায়।
টোলারবাগে কীভাবে লকডাউন পরিচালনা হচ্ছে
গত ২২শে মার্চ ওই এলাকার এক ব্যক্তি করোনাভাইরাসে মারা গেলে পরদিন থেকে অর্থাৎ ২৩শে মার্চ থেকে ওই এলাকাটি লকডাউন করে দেয় স্থানীয় এলাকাবাসী। পরবর্তীতে ওই এলাকার মালিক সমিতির সদস্যরা স্থানীয় সংসদ সদস্য, সিটি কর্পোরেশন, পুলিশ এবং আইইডিসিআর এর সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় লকডাউন পরিচালনা শুরু করে। তবে তারা লকডাউনের নামে কোন বাঁশ আটকে দেয়নি। বরং এলাকাটিতে প্রবেশের তিনটি গেইট বন্ধ করে দিয়েছে।
গত ৩৬ দিন ধরে ওই এলাকার ৪০টি পরিবার কোয়ারেন্টিনে রয়েছে। এরমধ্যে বাইরে থেকে কোন কাজের লোক এবং অতিথিদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এ বিপুল সংখ্যক বাসিন্দাদের যেন বাইরে বের হতে না হয় সেজন্য মালিক সমিতির পক্ষ থেকে এমন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে যাতে কারও ভোগান্তি না হয়।
উত্তর টোলারবাগ মালিক সমিতির সভাপতি শুভাশিস বিশ্বাস জানিয়েছেন, সাধারণ মানুষ যেন প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটা করতে পারেন সেজন্য আশেপাশের মুদির দোকানগুলো সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত খোলা রাখতে বলা হয়েছে। এসব দোকানের ফোন নম্বর ওই ৪০টি পরিবারকে দিয়ে রাখা হয়েছে। তারা প্রয়োজনে দোকানগুলোয় ফোন দিয়ে জানিয়েছে দেন কী কী লাগবে।
সে অনুযায়ী দোকানের লোকজন সব বাজার বাড়ির গেটের বাইরে দিয়ে যায়। ভবনের দারোয়ান সেই বাজারের ব্যাগগুলো জীবাণুমুক্ত করে যার যার ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করে। একইভাবে গ্যাসের প্রিপেইড মিটারের বিল, মোবাইল রিচার্জ, জরুরি ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থাও করা হয়। তবে যাদেরকে চিকিৎসার প্রয়োজনে বা চাকরি সূত্রে বাইরে যেতেই হয় তাদেরকেও মাস্ক, গ্লাভস পরার পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে বলা হয়েছে।
তারা যে গাড়িতে চলাচল করেন সেটা এলাকার প্রবেশের আগে জীবাণুনাশক ছিটিয়ে জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে। এছাড়া ওই এলাকার দারোয়ানরাও নিরাপত্তার জন্য মাস্ক, গ্লাভস করছেন।
বাঁশ দেয়া হচ্ছে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই
উত্তর টোলারবাগের দেখাদেখি ঢাকার অন্য এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের এলাকা লকডাউন করা শুরু করেছে। কিন্তু তারা কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করছে না। ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ লালবাগ এলাকাতে পর পর কয়েকটি গলি বাঁশ দিয়ে আটকে সাইনবোর্ড টানিয়ে রাখতে দেখা গেছে। কিন্তু টোলারবাগের যে ব্যবস্থাপনা তার ছিটেফোঁটা নেই এখানে।
এরকম একটি অবরুদ্ধ ভবনের বাসিন্দা নুসরাত ইকবালের বলেন, স্থানীয়রা তাদের গলি বাঁশ দিয়ে বন্ধ করে দিলেও মানুষের চলাচল বন্ধ নেই।
‘নামেই অবরুদ্ধ। সবাই ইচ্ছামতো বাঁশ টপকে যাওয়া আসা করছে। ভেতরের সব দোকানপাট খোলা। মানুষজন রাস্তার চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে, ঘুরা-ফেরা করছে। লকডাউন কেয়ারই করছে না। সবাই মনে করছে ঈদের ছুটি।’ বলেন মিসেস ইকবাল।
উল্টো এই বাঁশ দিয়ে আটকে দেয়ার কারণে জরুরি প্রয়োজনে কোন গাড়ি ভেতরে ঢুকতে বা বের হতে না পারছেনা। যার কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ভেতরে থাকা মানুষগুলোকে। মিসেস ইকবালের শাশুড়ি কিছুদিন আগে অসুস্থ হলেও তাকে হাসপাতালে নেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ বাঁশ দিয়ে রাখায় কোন গাড়ি ঢোকানো যায়নি এবং তার অসুস্থ শাশুড়ির পক্ষে এতদূর হাটা সম্ভব না।
সামাজিক লকডাউনের নিয়ম কী?
বিজ্ঞানসম্মত উপায় ছাড়া এভাবে খেয়াল খুশি মতো অবরুদ্ধ করলে কোন লাভ হবে না বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআর এর উপদেষ্টা মোস্তাক হোসেন। তার মতে রোগতত্ত্ব নিয়ে যারা কাজ করেন তারাই নির্ধারণ করে দেবেন কতোটুকু এলাকা কিভাবে লকডাউন করতে হবে। কোন এলাকায় একজনের থেকে যদি একাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকেন তখন সেটাকে ক্লাস্টার বা গুচ্ছ বলে।
আইইডিসিআর এর রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা একটি বিজ্ঞানসম্মত নিয়ম অনুসরণ করে নির্ধারণ করে দেন যে আক্রান্ত বাড়ির আশেপাশে কতোটুকু এলাকা সামাজিকভাবে অবরুদ্ধ করতে হবে। আইইডিসিআর শুরুতে এই লকডাউন নিয়ে পরামর্শ দিলেও বর্তমানে সেই দায়িত্ব পালন করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
কিন্তু মি. মোস্তাক মনে করেন, সামাজিক কোয়ারেন্টিন সফল করতে হলে এই দায়িত্ব পুনরায় আইইডিসিআর-এর বিশেষজ্ঞ দলকেই দিতে হবে। তিনি বলেন,‘রোগতাত্ত্বিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই কন্টেইনমেন্ট এলাকা বা সামাজিক কোয়ারেন্টিন এলাকা নির্ধারণ করতে হয়। বিজ্ঞানসম্মত উপায় ছাড়া যদি অন্য কোন উপায়ে ইচ্ছামতো অবরুদ্ধ করা হয় সেটা কার্যকর হবে না। প্রয়োজনের কম এলাকা অবরুদ্ধ করলে ঝুঁকি থেকে যাবে। বেশি এলাকা অবরুদ্ধ করলে অযথা ভোগান্তি বাড়বে।’
করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে যে পরিমাণ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী আছেন তার অর্ধেকের বসবাস ঢাকা মহানগরীতে, মোট ২০৬০ জন।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট-আইইডিসিআর এরিমধ্যে ঢাকার কয়েকটি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হল, মিরপুর, বাসাবো রাজারবাগ, মোহাম্মদপুর, লালবাগ, যাত্রাবাড়ী, বংশাল, চকবাজার, মিটফোর্ড, উত্তরা, তেজগাঁও এবং মহাখালী। এসব এলাকায় এখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলেই পুরো ভবন না হলে এলাকা লকডাউন করে দিচ্ছে স্থানীয় এলাকাবাসী।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে নিজেদের ইচ্ছেমত বাঁশ আটকে দেয়াই কোন সমাধান নয় বলে জানিয়েছেন মি. হোসেন। এজন্য কোয়ারেন্টিনের আওতার বাইরে থাকা এলাকাবাসীকেও অবরুদ্ধ মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। সূত্র : বিবিসি