করোনার কারণে স্থবির বিশ্ব অর্থনীতি। বাদ যায়নি বাংলাদেশও। এমনই প্রেক্ষাপটে নতুন করে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিখাত নিয়ে। বর্তমান বাজারের প্রায় অর্ধেকই হারাতে পারে আইসিটিখাত। আর্থিকভাবে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। সরকারি সাহায্য চাইছেন উদ্যোক্তারা।
আইসিটি খাত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়েই ইতোমধ্যে করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। দেশি-বিদেশি সফটওয়্যার, দেশিয় হার্ডওয়্যার, বিজনেস বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) এবং ফ্রিল্যান্সার থেকে শুরু করে কেউই এই নেতিবাচক প্রভাবের বাইরে নয়। তাই এখনই কপালে ভাঁজ দেখা দিয়েছে এই খাত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।
দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের সংগঠনে দুই ধরনের সদস্য আছে যারা দেশীয় মার্কেটে কাজ করে এবং যারা বৈদেশিক মার্কেটে কাজ করে। কেউ কেউ আছেন যারা দুই ধরনের বাজারেই কাজ করেন। এদের সবাই ঝুঁকিতে আছেন। বেশিরভাগেরই কাজ আটকে আছে। আবার অনেকেই আছেন যারা কাজ করেছেন কিন্তু পেমেন্ট আটকে আছে। লোকাল এবং ফরেন-দুই ধরনের প্রেক্ষাপটের জন্যই বলছি।
বাজারের অর্ধেক পরিমাণ লেনদেন কমে যেতে পারে আশংকা করে বেসিস সভাপতি বলেন, লোকাল মার্কেটে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলারের কাজ করে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো। আর আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ আমরা রপ্তানি করি। কাজ কমে যাওয়া এবং কাজ আটকে যাওয়া দুটো দিকেই হিসেব করলে আর্থিক লেনদেন প্রায় ৫০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ কমে যাবে। অর্থ্যাৎ দেশি-বিদেশি দুই দিকেই প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার করে আর্থিক ক্ষতি হবে এই খাতে।
আলমাসের আশংকার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় আইসিটি খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যেও। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বন্ডস্টাইন টেকনোলজিসের পরিচালক যাফির শাফিঈ চৌধুরী বলেন, আইসিটি খাতে লোকাল আর ইন্টারন্যাশনাল দুই সেক্টরেই কাজ অনেক কম হচ্ছে এখন। লোকাল মার্কেটে কোম্পানিগুলো নতুন অটোমেশনে যাচ্ছে না বা যা করার কথা ছিল সেই কাজগুলোও আটকে যাচ্ছে কারণ সবারই ব্যবসার অবস্থা খারাপ।
ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটের মূল কেন্দ্রগুলো-যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান। এসব দেশে করোনার প্রভাব সবচেয়ে বেশি হওয়ার কারণে অর্থনীতি স্থবির। নতুন কাজ বন্ধ হয়ে আছে। কাজ আসছে না, বিল প্রসেসিং ও আটকে যাচ্ছে। অনেক প্রজেক্ট মাঝপথে আটকে থাকার কারণে বিনিয়োগ আটকে আছে। কর্মীদের বর্ধিত সময়ের জন্য বেতন এদেশের আইসিটি কোম্পানিগুলাকেই বহন করতে হচ্ছে। অফিস করা সম্ভব হচ্ছে না বলে হোম অফিসে কর্মীদের থেকে সম্পূর্ণ প্রোডাক্টিভিটি অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না কারণ অনেক খেত্রেই সমন্বয়ের মাধ্যমে যে কাজ সহজে হয় তা সম্ভব হচ্ছে না এবং মনিটরিং এর পরিবেশ পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়াও আইসিটি প্রজেক্টগুলো এখন অনেক খেত্রেই প্রয়োজনীয়তার তালিকায় নিচে চলে যাচ্ছে কারণ এখন সবাই অবশ্য প্রয়োজনীয় দিকগুলোতে খরচ করছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ হোসেন জানান, করোনা শেষ হলেও এর প্রভাব থাকবে দীর্ঘসময়।
তৌহিদ বলেন, ধরেন আজও যদি করোনার প্রাদুর্ভাব শেষ হয়ে যায় তবুও এর প্রভাব থাকবে আরও অন্তত প্রায় ছয় মাস। প্রভাব বলতে নেতিবাচক প্রভাব। আবার আমরা অনুমান করতে পারছি এখনই এই প্রাদুর্ভাব কমবে না বরং কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তাও জানি না। এখনই আমাদের বেশিরভাগ গ্রাহক প্রতিষ্ঠান তাদের কাজ বন্ধ রেখেছে। আমাদের কিছু কর্মী বাসায় থেকে কাজ করছেন। আবার কিছু কর্মী অফিসে থেকে কাজ করছেন। দুই সপ্তাহের ওপরে তারা অফিসেই থাকছেন। অফিসও লকডডাউন। পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে এর ফলাফল আরও খারাপ হবে। এই খাতে বাৎসরিক প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বাজার আছে। এর অর্ধেক প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের বাজার কমে যাবে। আমরা প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রাহক হারানোর আশংকা করছি।
এমনই প্রেক্ষাপটে সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তা চাচ্ছেন আইসিটি খাতের উদ্যোক্তারা। ইতোমধ্যে সরকারের কাছে এক হাজার ৯০০ কোটি টাকা অনুদানের আবেদন করে অর্থমন্ত্রীর বরাবর চিঠি দিয়েছে বাক্য। অন্যদিকে সরল সুদে উদ্যোক্তাদের জন্য লোন দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে বেসিসের পক্ষ থেকে।
বেসিস সভাপতি আলমাস কবীর বলেন, আমরা প্রস্তাব করেছি যে, ৫০০ কোটি টাকার একটা তহবিল গঠন করে সেখান থেকে উদ্যোক্তাদের সরল দুই শতাংশ হারে লোন দেওয়া হোক। আর এই লোন হতে হবে জামানতবিহীন এবং এক বছরের ‘গ্রেস পিরিয়ড’ থাকতে হবে। জামানতবিহীন লোন সুবিধা না দিলে ব্যবসায়ীরা এটি নিতে পারবেন না। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই সংকটে পড়ে যাবে।