রাজধানীর অদূর আশুলিয়ার গণকবাড়িসহ পাশ্ববর্তী এলাকায় বসবাস করে একটি জনগোষ্ঠীর ৩০০টি পরিবার। এদের অনেকে ঢাকা রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের (ডিইপিজেড) বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় কাজ করতেন। অনেকে আবার বিভিন্ন সেলুন ও বিউটি পার্লারে কাজ করেন।
তবে কোভিড-১৯ এই পরিবারগুলোর জীবনে দুঃস্বপ্ন বয়ে এনেছে। টানা চার মাসের অচলাবস্থার কারণে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে সেলুন-বিউটি পার্লারেও লোকের আনাগোনা কম। ফলে কমেছে আয়।
করোনার এই প্রভাব কোনো একটি বিশেষ এলাকাতেই থেমে নেই। সর্বত্র স্বাস্থ্যঝুঁকি ছড়ানোর পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে মানুষের আয়-রোজগারেও নিষ্ঠুর থাবা বসিয়েছে। গৃহকর্মী থেকে গার্মেন্ট শ্রমিক, দিনমজুর, রেস্টুরেন্টকর্মী, ক্ষুদ্র ভাসমান ব্যবসায়ী, অটোচালক, গ্রামের কৃষক, জেলে, দোকানদার, বিদেশফেরত কিংবা কর্পোরেট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীও এর শিকার হয়েছেন।
আর আয় কমায় সঞ্চিত অর্থের প্রবাহ বাজারে গড়াচ্ছে খুব কমই। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। স্বল্প পরিসরে দোকানপাট খোলা থাকলেও সেখানে বেচাকেনায় মন্দা অবস্থা বিরাজ করছে। বেশিরভাগ পরিবারের পুষ্টিপূরণ ও বিলাসিতা একরকম শূন্যের কোঠায় নেমেছে। এমনকি বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য কিনতেও আপস করছেন অনেকে।
কোভিড-১৯ মহামারিতে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি নানামুখী অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হচ্ছে। বাড়ছে বেকারত্ব। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আয় ও ভোগ বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এ বিষয়ক সাম্প্রতিক জরিপে করোনার প্রভাবে বাংলাদেশে অন্তত দেড় কোটি মানুষের চাকরি হারানোর আশংকা করা হয়েছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনেও এ বিষয়ে দাবি করা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে আছে নিম্নআয়ের মানুষ। তবে দারিদ্র্যের প্রবণতা বাড়তে থাকবে সারাদেশেই।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, করোনার ধাক্কায় দেশে নতুন করে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ গরিব হয়েছে। অর্থাৎ নতুন ও পুরনো মিলিয়ে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দেশে এখন মোট জনগোষ্ঠীর ৪৩ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। যেখানে এখন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ কোটির ওপরে।
অপরদিকে চলতি মাসে প্রকাশিত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পরিচালিত কোভিডকালীন বাংলাদেশের অর্থনীতি: ২০১৯-২০ অর্থবছর শীর্ষক পর্যালোচনা প্রতিবেদনেও মানুষের আয় কমে যাওয়ার জোরালো আভাস দেওয়া হয়। এতে চাহিদা ও ভোগ হ্রাসের বৈষম্য বাড়ার প্রকৃত রূপও ধরা পড়েছে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ২০১৬ সালে দেশে আয় বৈষম্যের যে গিনিসূচক ছিল ০.৪৮, সেটি ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ০.৫২-এ। একইভাবে ভোগের ক্ষেত্রেও বৈষম্যের বাড়তি প্রতিফলন দেখা গেছে। ২০১৬ সালে ভোগ বৈষম্যের গিনিসূচক যেখানে ছিল ০.৩২, সেখানে ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০.৩৫-এ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ‘বিগত কয়েক বছর ধরেই দেশে আয় ও ভোগের বৈষম্য বেড়ে চলেছে। তবে করোনায় এখন তা অতি মহামারি সৃষ্টি করেছে। এর ফলে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে। যা মানুষের ক্রয় ও ভোগ চাহিদায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। আবার উল্টোপিঠে ক্রয় ও ভোগকেন্দ্রিক বৈষম্যও সূচিত হয়েছে। ’
এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে মানুষকে আয়বর্ধক কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি সৃষ্ট বৈষম্য নিরসনে মনযোগী হওয়ার তাগিদ দেন তিনি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বৈশ্বিকভাবেই সময়টি খারাপ যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও মানুষের আয় পরিবর্তনের দরুণ চাহিদা ও ভোগ কমেছে। এর ফলে আমাদের রফতানিও কমেছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির এ চিত্র বাংলাদেশেও জোরালোভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। মানুষকে কর্মমুখী ক্ষেত্রে ধরে রাখতে না পারলে এবং আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গেলে ভোগ ও ক্রয় উভয় চাহিদাই কমবে। পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতাও বাড়বে।’
অন্যদিকে করোনা পরিস্থিতিকে মানুষের আর্থ-সামাজিক অধঃপতনের একটি জরিপ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। অর্থনীতিবিদদের এই সংগঠনটি ২৬ মার্চ-৩০ মে পর্যন্ত মোট ৬৬ দিনের হিসাব দেখিয়ে বলেছে, এই সময়ে কাজ হারিয়েছেন ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ। এর ফলে আর্থ-সামাজিক শ্রেণি-কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে ৫ কোটি ৯৫ লাখ মানুষের। যেখানে নতুন করে হতদরিদ্র হয়েছেন ২ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ।