সারাদেশে চলছে মহামারির ভয়াবহ প্রকোপ। এখন প্রতিদিন সাধারণ মানুষসহ কোভিড-১৯ নামক এই মহামারিতে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে চিকিৎসকরাও। যার ফলে দেশে তীব্র হয়ে উঠেছে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্কট।
এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় চিকিৎসা ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে দেশের কয়েক হাজার গ্রাজুয়েট ও আন্ডারগ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট বা ফার্মাসির শিক্ষার্থীদের।
সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৫৪টি। আর বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৫ হাজার ৫৫টি। এদিকে সরকারি স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত মোট চিকিৎসকের সংখ্যা বর্তমানে মাত্র ২৫ হাজার ৬১৫ জন।
আর চিকিৎসক, সেবিকা ও নানা পর্যায়ের হাসপাতালকর্মী মিলে মোট জনবল কর্মরত রয়েছেন ৭৮ হাজার ৩০০ জন। যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ জনগণের এক রাষ্ট্রের মহামারি মোকাবেলায় নিতান্তই নগন্য। এছাড়াও সারাদেশে মাত্র ১১টি হাসপাতালে করোনা সেবা দেয়া হচ্ছে ও সরকারি তথ্য মতে আরো ১১টি প্রস্তুত কাজ চলছে।
কিন্তু প্রকৃত অর্থে বিবিসির এক প্রতিবেদন হতে জানা যায়, এর সবগুলোতে এখনো পুরোদমে কাজ শুরু হয়নি। ফলে করোনা আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীই চিকিৎসা নিচ্ছেন বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে হাসপাতালটি তাদের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও হাসপাতালটি করোনাভাইরাস চিকিৎসার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয় বলে জানিয়েছে হাসপাতালটির বিভিন্ন সূত্র। প্রস্তুত নয় অনেক চিকিৎসকরাও।
আর ‘মরার উপর খাড়া’ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেবা দিতে গিয়ে ২২ জন চিকিৎসক, পাঁচজন নার্স ও চারজন টেকনিশিয়ান করোনায় আক্রান্ত হওয়ায়। চিকিৎসক, নার্সসহ অর্ধশতাধিক স্বাস্থ্যকর্মী বর্তমানে কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। যা রোগীদের সেবার জন্য আরো হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
তাই জাতির এই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে বাংলাদেশ ফার্মাসিস্টস ফোরামের উদ্যোগে ‘এ’ গ্রেড ফার্মাসিস্টদের ভলান্টিয়ার সংগ্রহের কাজ চলছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি শিক্ষার্থী ও ফার্মাসিস্ট দেশের এই বিপদে সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগকে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। কারণ ডাক্তার ও নার্সদের পাশাপাশি ফার্মাসিস্ট থাকলে প্রতিটি হাসাপাতালের স্বাস্থ্যসেবা হবে শক্তিশালী। ইউরোপ, আমেরিকার দিকে নজর দিলে দেখা যায় তাদের স্বাস্থ্যসেবা ডাক্তার, ফার্মাসিসস্ট ও নার্সদের সমন্বয়ে পরিচালিত হয় বলেই তাদের স্বাস্থ্যসেবা এতোটা উন্নত ও যুগোপযোগী।
দেখা যায়, হাসপাতালের ফার্মাসিস্টদের মূল কাজ হচ্ছে ডাক্তারদের সাথে আলোচনা করে ওষুধের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। রোগীকে ওষুধের সঠিক ডোজেস ফর্ম বুঝিয়ে দেয়া। ওষুধের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা ও রোগীদের ওষুধের প্রভাব সম্পর্কে পরামর্শ দেয়া।
এছাড়াও ওষুধের প্রতি রোগীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ করা, একাধিক ওষুধ সেবনের ক্ষেত্রে “ড্রাগ-ড্রাগ ইন্টারেকশন” যাচাই করা, ধারাবাহিক ওষুধ সেবনে রোগের মাত্রা নিরীক্ষা করা, ভিন্ন ভিন্ন বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করাসহ রোগীর আর্থিক ক্রয়ক্ষমতার দিকে লক্ষ্য রেখে সর্বোচ্চ গ্রহণ উপযোগী, নিরাপদ ও কার্যকর ওষুধ নির্বাচন করা।
কিন্তু প্রশ্ন হলো আমাদের দেশের ফার্মাসিস্টরা এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কি প্রস্তুত?
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এস এম আব্দুর রহমান বলেন, ‘এই সঙ্কটের মুহূর্তে ফার্মাসিস্টরা জাতির প্রয়োজন মেটাতে ওষুধ প্রস্তুত ও সরবরাহ অব্যাহত রাখতে কঠোর পরিশ্রম করছেন। তারা সেখানে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অন্যান্য পেশাজীবীর পাশাপাশি তাদের কাজের জন্য প্রশংসা করা উচিত।
তিনি আরো বলেন, ফার্মাসিস্টরা কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য চিকিৎসকদের সাথে হাসপাতালে কাজ করার জন্য প্রস্তুত বলে আমি মনে করি। এই সঙ্কটের মুহূর্তে ফার্মাসিস্টরা এই পরিস্থিতিটি কাটিয়ে উঠতে দুর্দান্ত ভূমিকা নিতে পারে। তারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবেও কাজ করতে আগ্রহী।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আব্দুল মুহিত তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘গ্র্যাজুয়েট বা আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে জরুরী স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত করুন। একজন ফার্মাসিস্ট চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার প্রাথমিক জ্ঞানসমূহ সম্পর্কে অবগত। তবুও প্রয়োজনে চিকিৎসকদের দিয়ে গ্র্যাজুয়েট বা আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের ৭ বা ১০ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে কম ঝুঁকিসম্পন্ন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা বা ওষুধ প্রদান সম্পর্কিত সেবা বা নতুন ওষুধের ট্রায়ালে নিয়োজিত করা উচিত।”
ড. আব্দুল মুহিত মনে করেন, এই বিষয়ে একটি জাতীয় উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণের এখনই সঠিক সময়। এখনই প্রশিক্ষণ শুরু করে দিলে গুরুতর মুহূর্তে তারা কাজে লাগবেই।
ভবিষ্যৎ লাখ লাখ আক্রান্তের আশঙ্কা রয়েছে। সেই দুর্যোগ মোকাবলায় তিনি মনে করেন, হাসপাতাল থেকে শুরু করে ক্লিনিক কিংবা বিভিন্ন খোলা ময়দানে সাময়িক স্বাস্থ্য ক্যাম্প করে মানুষের চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে। যদি আক্রান্ত নাও হয়, তবুও সঠিক জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনবল তৈরি হয়ে যাবে, যাদের ভবিষ্যতেও কাজে লাগানো যাবে।
ফার্মেসি কাউন্সিলের সচিব জনাব মুহাম্মদ মাহবুবুল হক বলছেন, ‘দেশের এই দুর্যোগের মুহূর্তে চিকিৎসকদের সহযোগিতা করতে প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ দিয়ে ভলান্টিয়ার স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে ফার্মাসিস্টদের নিযুক্ত করা যেতে পারে।’
তিনি আশা করে বলেন, ‘ফার্মাসিস্টরা সফলতার সাথেই ডাক্তারদের পাশাপাশি থেকে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন।’
এছাড়াও বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় যে ওষুধগুলো এখন অন্যান্য দেশে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে যেমন- ক্লোরোকুইন বা হাইড্রক্সিক্লোরকুইন ও অ্যাজিথ্রোমাইসিনের কম্বিনেশন, গিলিয়াড ফার্মার “রেমডিসিভির”, জাপানের ফুজিফিল্ম তোইয়ামা কেমিক্যালের “ফ্যাভিপ্রাভির” (যা এইচআইভি এইডস চিকিৎসায় ব্যবহৃত)। আমাদের দেশে এ সকল ওষুধ কোভিড-১৯ রোগীদের উপর পরীক্ষা করতে হলে দরকার ডাক্তার ও ফার্মাসিস্টদের সম্মিলিত গবেষণা। এ ওষুধগুলো এখনো কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ট্রায়াল পর্যায়ে আছে।
২০১৮ সালের ২৪ মার্চ সরকারের একটি প্রজ্ঞাপনে প্রত্যেক হাসপাতালে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগের (গ্রেড-৯) জন্য একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু, কোনো অজ্ঞাত কারণে এটির অগ্রগতি বা পরবর্তী ধাপ স্থগিত হয়ে যায়। উন্নতদেশের চালুকৃত ‘হাসপাতাল ফার্মেসি সার্ভিসের’ অনুসরণে এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল।
গ্র্যাজুয়েট ও আন্ডারগ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে মহামারিজনিত জরুরি স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত করার এটিই প্রকৃত সময়। এই দুর্যোগ প্রতিরোধে এ রকম একটি সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে মনে করছে অনেক বিশেষজ্ঞ।