কিশোরগঞ্জ জেলায় প্রথম করিমগঞ্জ উপজেলার জঙ্গলবাড়ি মুসলিমপাড়া গ্রামে মারা যাওয়ার পর এক ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষায় গত ৯ই এপ্রিল করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ পজেটিভ শনাক্ত হয়। এরপর থেকেই জেলাজুড়ে করোনার বিস্তার শুরু হয়। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৫০ ছাড়ায় আক্রান্তের সংখ্যা। এরপরই যেন রুদ্রমূর্তি ধারণ করে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস।
গত ১৭ই এপ্রিল পর্যন্ত মোট শনাক্ত হওয়া ৫২ থেকে তিন অঙ্ক অতিক্রম করতে সময় লাগে মাত্র দুইদিন। ১৮ই এপ্রিল নতুন করে করোনা শনাক্ত হন ২২ জন। পরদিন ১৯শে এপ্রিল জেলায় একদিনে সর্বোচ্চ ৬৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়। ফলে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪১ জনে।
এরকম পরিস্থিতিতে ঝুঁকিপূর্ণ জেলার তালিকায় উপরের দিকে উঠে আসে কিশোরগঞ্জের নাম। পরের দিন আরো ২৫ জন আক্রান্ত হলে ১৬৬ জন করোনা শনাক্ত নিয়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের পরেই সংক্রমণ ঝুঁকির জেলা হয়ে ওঠে কিশোরগঞ্জ।
এছাড়া এই সময়ে জেলায় মারা যাওয়া তিনজনের নমুনায় করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ পজেটিভ ধরা পড়ে। শুরু হয় জেলাজুড়ে আতঙ্ক। এই আতঙ্কের মধ্যেই কমতে শুরু করে সংক্রমণ।
জেলার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে গত ২৫শে এপ্রিল করোনাভাইরাস মুক্ত হয়ে সুস্থ হন জেলার ইটনা সদর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুর রশীদ। এরপর থেকেই অভাবনীয়ভাবে বাড়তে থাকে সুস্থ হওয়ার সংখ্যা। ইতোমধ্যে আক্রান্তের ৬০ শতাংশ সুস্থ হয়ে ওঠেছেন। নতুন করে সংক্রমণও তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। যেন সহসাই করোনাজয়ের পথে হাঁটছে কিশোরগঞ্জ।
কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, সোমবার (৪ মে) রাত পর্যন্ত পাওয়া নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টের ভিত্তিতে কিশোরগঞ্জ জেলায় মোট ১৮৮ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ৫ জন।
বাকি ১৮৩ জনের মধ্যে দুইজন এসিল্যান্ড, ৪৮ জন চিকিৎসক, ১১ জন পুলিশ সদস্য এবং অর্ধশতাধিক হাসপাতাল স্টাফ রয়েছেন।
এ পরিস্থিতিতে জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফ আক্রান্ত হওয়ায় হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা কার্যক্রম জনবল সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে পড়ে। এর মধ্যে করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে লকডাউন করে দেয়া হয়েছিল।
করোনা আক্রান্ত ১৮৩ জনের মধ্যে ইতোমধ্যে ১১২ জন সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের লকডাউন প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে।
বর্তমানে মোট ৭১ জন বিভিন্ন হাসপাতাল ও নিজ বাড়িতে আইসোলেশনে রয়েছেন। তাদের মধ্যেও বেশ কয়েকজন সুস্থতার ছাড়পত্র পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।
সিভিল সার্জন ডা. মো. মুজিবুর রহমান জানান, কিশোরগঞ্জ জেলায় দিন দিনই করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। জেলায় মোট ১৮৮ জনের মধ্যে উপজেলাওয়ারী হিসাবে, কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার ১৭ জন, হোসেনপুরে ৩ জন, করিমগঞ্জে ১৭ জন, তাড়াইলে ২৮ জন, পাকুন্দিয়ায় ৪ জন, কটিয়াদীতে ১৪ জন, কুলিয়ারচরে ১০ জন, ভৈরবে সর্বোচ্চ ৪৬ জন, নিকলীতে ৫ জন, বাজিতপুরে ৬ জন, ইটনায় ১১ জন, মিঠামইনে ২৪ জন ও অষ্টগ্রামে ৩ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
তাদের মধ্যে পাঁচজন মৃত ব্যক্তি রয়েছেন। তারা হলেন, কটিয়াদী উপজেলার করগাঁও ইউনিয়নের বাট্টা গ্রামের তরুণ ভূইয়া (৪০), করিমগঞ্জ উপজেলার জঙ্গলবাড়ি মুসলিমপাড়া গ্রামের সেলিম মিয়া (৪৬), কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের বড়বাজার টেনু সাহার গলি এলাকার নিতাই (৬০), হোসেনপুর উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ পানান গ্রামের ১০ বছর বয়সী শিশু মিজান এবং কুলিয়ারচর উপজেলার গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের মাতুয়ারকান্দা গ্রামের মোস্তফা মিয়া (৬০)।
তাদের মধ্যে মোস্তফা মিয়া করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর নিজ বাড়িতে আইসোলেশনে থাকা অবস্থায় মারা যান এবং বাকি চারজনেরই মারা যাওয়ার পর নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টে করোনা পজেটিভ আসে।
অন্যদিকে এখন পর্যন্ত ১১২ জন সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। উপজেলাওয়ারী হিসাবে, কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার ৮ জন, হোসেনপুরে ১ জন, করিমগঞ্জে ১৩ জন, তাড়াইলে ১৪ জন, পাকুন্দিয়ায় ২ জন, কটিয়াদীতে ৯ জন, ভৈরবে সর্বোচ্চ ৩২ জন, নিকলীতে ৪ জন, ইটনায় ১০ জন, মিঠামইনে ১৮ জন ও অষ্টগ্রামে ১ জন করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ্যতা লাভ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুস্থ হওয়া মোট ১১২ জনের মধ্যে কিশোরগঞ্জের করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে মোট ২৭ জন করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। হাসপাতালটিতে করোনা চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন করোনাজয়ীরা।