ঢাকায় কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে শুরু থেকেই সেবার সাথে জড়িত রয়েছেন এমন একজন নার্স বলছেন, যে সুরক্ষা পোশাকটি খুব দরকারি সেই পিপিই তাদের পুরোটা দেয়া হচ্ছে না। শুধু গাউন দেয়া হচ্ছে এবং খুব দরকারি এন-৯৫ মাস্কও দেয়া হচ্ছে না।
এই হাসপাতালটিতে প্রথম দেশের করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া শুরু হয় এবং এখনো পর্যন্ত সেখানেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
এই নার্সের পরিচয় আমরা গোপন করছি।
তিনি বলছেন, ‘আমরা একটা রোটেশন ঠিক করে নিয়েছি রোগীর ক্লোজ কন্টাক্টে কোনদিন কে যাবে। যেমন একদিন তিনজন পিপিই পরবে ও রোগীদের কাছে যাবে। আর অন্যরা নার্সিং স্টেশনে ডিউটি করবে। তারা আবার অন্যদিন পিপিই পরবে।’
এই নার্সদের রোগীর অনেক বেশি কাছে যেতে হচ্ছে যথেষ্ট সুরক্ষা সামগ্রী পরিধান না করেই। তাই প্রতিনিয়ত আশঙ্কার মধ্যে থাকতে হয় তাদের।
ওই নার্স বলেছেন, ‘রোগী হাসপাতালে এলে আমরা তাকে রিসিভ করা থেকে শুরু করে তাকে ওষুধ দেয়া, রোগীকে স্যালাইন দেয়া, এমনকি আমাদের হাসপাতালে ইসিজি টেকনিশিয়ান না থাকায় আমরা রোগীর ইসিজিও করি। ইনজেকশন দিতে হয়।’
এসব কারণে নার্সদের রোগীর খুব কাছে, রোগীর মুখের কাছেও ক্লোজ কন্টাক্টে বা অনেক কাছে যেতে হয়। যা করোনাভাইরাস সংক্রমণের বড় ঝুঁকির সৃষ্টি হয়।
কিন্তু যে সুরক্ষা সামগ্রী রয়েছে যা বেশিরভাগই চিকিৎসকদের জন্য বরাদ্দ বলে তিনি জানান।
‘চিকিৎসকদের কাছেই বেশিরভাগ এন-৯৫ মাস্ক, পিপিই ও শু কভার। চিকিৎসকেরা অনেক সময় রোগীদের স্পর্শ করেন না। কিন্তু সুরক্ষা সামগ্রীর বড্ড অভাব রয়েছে সেবিকাদের জন্য’, তিনি বলেন।
রোগী যখন আসেন তখন চিকিৎসকরা দূর থেকে রোগীর ইতিহাস নেন।
কিন্তু তাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সব ওষুধ, ইনজেকশন নিয়ে এই নার্সদেরই রোগীদের কাছে যেতে হয়।
পরে ডাক্তাররা যখন নিয়মিত রাউন্ডে যান, তারা বেশিরভাগ সময় রোগীর গায়ে হাতও দেন না। কিন্তু রোগীদের সংস্পর্শে যাওয়া ছাড়া নার্সদের সেবা দেয়ার কোন উপায় নেই।
ডেথ ক্লিয়ারেন্স দিতে হলে চিকিৎসকদের যেতে হয় ঠিকই কিন্তু রোগী মারা গেলেও নার্সদের পাঠানো হয়।
নার্সদের যেসব সুরক্ষা সামগ্রী দেয়া হচ্ছে তার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলছেন, ‘আমাদের প্রথম কিছুদিন ফুল পিপিই দেয়া হতো। তবে সপ্তাহখানেক হল শুধু পিপিই গাউনটা দেয়া হচ্ছে। এন-৯৫ যে মাস্ক সেটি আমরা আর পাচ্ছি না। আমরা নরমাল মাস্ক পরে রোগীদের কাছে যাচ্ছি। গগলস প্রথম দিকে পেয়েছি, এখন আর সেটা দেয়া হচ্ছে না। সাধারণ চশমা ও সাধারণ মাস্ক দেয়া হচ্ছে। শু কাভার দেয়া হচ্ছে না। আমরা পায়ে বাইরের পলিথিন পেঁচিয়ে কাজ করছি।”
তাদেরকে বলা হয়েছে এন-৯৫ মাস্কের সরবরাহ নেই। তাদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে একের অধিক মাস্ক পরে রোগীর কাছে যেতে।
তারা এতোটাই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন যে, অনেকে নিজের টাকা দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে অনলাইন শপে এন-৯৫ কেনার চেষ্টা করেন।
‘চিন্তা করুন কতটা অসহায় হলে এই উদ্যোগটা নিতে হয়?’ আক্ষেপের স্বরে বলেন ওই নার্স।
তিনি বলেন, ‘আমি রোগীর কাছে যেতে চাই, আমি সেবা করতে চাই সেই মানসিকতা আমার আছে কিন্তু আমি নিজে সুস্থ থাকতে চাই। সুস্থ থেকে রোগীর সেবা করতে চাই।’
এই সেবিকাদের টানা সাত দিন ১২ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয় এবং এরপর ১৪ দিন তারা একটি হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে থাকেন।
যে হোটেলে তাদের রাখা হয়েছে সেখানকার রাঁধুনি পালিয়ে যাওয়ার পর তাদের বিপাকে পড়তে হয়েছিল। এছাড়া তাদেরকে যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর খাবার দেয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে।
বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন থেকে জানানো হয়েছে সরকারি হাসপাতালে ইতিমধ্যেই ১১ জন নার্স করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আর বেসরকারি হাসপাতালে ১৩ জন সেবিকা আক্রান্ত হয়েছেন বলে তারা জানতে পেরেছেন।
অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ইসমত আরা পারভীন বলছেন, ‘সারাদেশে নার্সরা মানসম্মত পিপিই পাচ্ছেন না। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে তারা একবার ব্যবহার যোগ্য পিপিই ধুয়ে আবার ব্যবহার করছেন। ফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে অনেক নার্স বিষয়টা আমাদের জানিয়েছেন।’
সূত্র : বিবিসি