মহামারি করোনাভাইরাসের কয়েকটি ভ্যাকসিন পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই আমরা চিকিৎসার জন্য ওষুধ আর প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন পেয়ে যাব। কিন্তু যতদিন না পাচ্ছি ততদিন আমাদের সাধারণ মানুষের দু’টি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া দরকার। একটি হলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এবং অন্যটি হলো শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের কিছু জ্ঞান রয়েছে (যেমন সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি)। ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হচ্ছে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করা যাতে আমরা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলেও আমাদের শরীর লড়াই করতে পারে এবং ভাইরাসটি শরীরের খুব বেশি ক্ষতি না করতে পারে।
সাধারণত যখন আমরা ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আক্রান্ত হই তখন রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এর বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে, শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে এবং বাইরে থেকে ঢোকা জিনিসগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে। বিভিন্ন কারণে আমাদের দেহের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কখনো কখনো দুর্বল হয়ে পড়ে তবে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আবার শক্তিশালীও হতে পারে।
যেভাবে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারি:
ভিটামিন ও মিনারেল
ভিটামিন ও মিনারেলের মতো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জোরদার করতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কাজেই প্রাকৃতিক উৎস থেকে ভিটামিন এবং মিনারেল সংগ্রহ করা বুদ্ধিমানের কাজ। আপেল, কমলা, লেবু, পালং শাক, ব্রকলি, ব্রাসেলস স্প্রাউট এগুলো থেকে ভিটামিন সি পাওয়া যেতে পারে । ভিটামিন সি ট্যাবলেট থেকেও এটা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ভিটামিন সি এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? দেখা গেছে চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়ে ভিটামিন সি’র আইভি ফরম্যাট ইনজেক্ট করা চিকিৎসার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এবং এতে বেশ খানিকটা সফলতা পাওয়া গেছে। শরীরে ভিটামিন ডি পাওয়ার জন্য আমরা রোদের সংস্পর্শে যেতে পারি। বাসার জানালা খুলে অথবা খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে সপ্তাহে ২-৩ দিন ১০-১৫ মিনিটের জন্য রোদ উপভোগ করতে পারি। মাছের তেল, গরুর কলিজা, পনির এবং ডিমের কুসুম ভিটামিন ডি’র অন্যতম উৎস। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে জিংকের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। ডাল আদা সামুদ্রিক মাছ বাদাম ডিম দুধ মাংস এবং বীজ থেকে জিংক পাওয়া যায়।
প্রবায়োটিকস
প্রবায়োটিকস হলো ভালো ব্যাকটেরিয়া যেগুলো আমাদের খাদ্যনালী এবং অন্ত্রে খারাপ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাস্থ্যকর অবস্থা বজায় রাখে। দই, আচার, বাটার মিল্ক, পনির প্রবায়োটিকসের ভালো উৎস।
মধু
মধু শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দেয় এবং হাইড্রোজেন পার অক্সাইড তৈরি করে এটি ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধ করে। এটি শরীরকে কষ্ট সহিষ্ণু করে তোলে এবং পেশীর ক্লান্তি দূর করে।
গ্রিন টি
গ্রিন টি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ভালো উৎস যা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে।
স্ট্রেস হ্রাস
এই মহামারি এবং লকডাউন চলাকালীন চাপমুক্ত থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক খুব ভালো পরামর্শ দিয়েছেন তিনি বলেছেন, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য আমরা যেন খুব বেশি হলে দিনে দু’বার নিউজ চ্যানেল বা বিশ্বাসযোগ্য ওয়েবসাইট থেকে খবর সংগ্রহ করি এবং খারাপ পরিস্থিতির জন্য চাপ না নেই।
ক্রনিক রোগ প্রতিরোধ
বয়স বাড়লে শরীরের রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। দীর্ঘস্থায়ী রোগ সেই প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে তোলে। আমরা আমাদের বয়স কমাতে পারি না। কাজেই হাতে যা আছে তা হলো ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানির মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগ নিয়ন্ত্রণ করে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র যথাযথভাবে অনুসরণ করা।
ধূমপান বন্ধ করা
ধূমপান ফুসফুসকে দুর্বল করে এবং এসিই২ নামের এনজাইম উৎপন্ন করে যা ভাইরাসের জন্য ফুসফুসে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারে। তাই এখনই ধূমপান বন্ধ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যালকোহল হ্রাস
এন এইচ এস, ইউকে এর গাইডলাইন অনুযায়ী অ্যালকোহল গ্রহণ কমালে তা লিভারের ওপর চাপ কমাতে এবং সামগ্রিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে সহায়ক।
ওজন হ্রাস এবং বাড়িতে নিয়মিত অনুশীলন
দেশের আইন অনুযায়ী এই সময়ে বাইরে অনুশীলনের সুযোগ না থাকলে অবশ্যই যোগব্যায়াম, অ্যারোবিক্স টাইপ ইনডোর অনুশীলন করতে হবে। নিয়মিত অনুশীলন এবং স্বাস্থ্যকর ডায়েটের মাধ্যমে বি এম আই অনুযায়ী সঠিক ওজন বজায় রাখা খুব জরুরি।
খাওয়া-ঘুম
এই সময়ে শাকসবজি ও খাবার পানিসহ স্বাস্থ্যকর ডায়েট বাধ্যতামূলক। প্রতিদিন কমপক্ষে আড়াই থেকে তিন লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। উপযুক্ত ঘুম প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ কারণ এতে সাইটোকাইন তৈরি হয় যা সরাসরি ইনফেকশনের বিরুদ্ধে কাজ করে। এই লকডাউনের সময় আমরা অনেকেই ডিজিটাল পর্দার (যেমন মোবাইল, কম্পিউটার টিভি ইত্যাদি) ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এরকম করলে হবে না ঘুমানোর কমপক্ষে দুই ঘণ্টা আগে থেকে সমস্ত ডিজিটাল পর্দা থেকে বিরতি নিতে হবে যাতে ঘুম গাঢ় হয় এবং আমরা সাইটোকাইনের সুবিধা নিতে পারি।
সংক্রমণ এড়ানো
আমরা সংক্রমণ এড়ানোর জন্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। আমাদের সাবান বা স্যানিটাইজার ব্যবহার করে ঘন ঘন হাত ধোয়া, নিয়মিত প্রতিদিনের ব্যবহার্য জিনিসপত্র পরিষ্কার করা, কাঁচা খাবার ভালো করে রান্না করে খাওয়া এবং খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়া।
মহামারি বিরোধী লড়াইয়ে বিশ্বের জনসংখ্যার প্রতিটি সদস্যের ভূমিকা রয়েছে। সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের কাজটুকু আমাদের করতে হবে, নিজেদের স্বাস্থ্যবান এবং শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন রাখতে হবে। তাহলে হেলথ কেয়ার সিস্টেমের ওপর চাপ কম পড়বে। যাদের বেশি দরকার তারা সেবা পাবে এবং জাতিগতভাবে আমরা মহামারির বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে উতরে যাব।
ডা. সুমাইয়া আক্তার
পিএইচডি গবেষক, মাইক্রোবায়োলজি
হারকিউলিস ল্যাবরেটরি, ইউনিভার্সিটি অফ এভরা, পর্তুগাল
এক্স- সিনিয়র মেডিকেল অফিসার
কার্ডিওলজি, ইউনাইটেড হসপিটাল , ঢাকা