খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে করোনা উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসা নিতে এসে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের অভিযোগের শেষ নেই। করোনা সাসপেকটেড আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তির পর সার্বক্ষণিক চিকিৎসক না পাওয়া, ভর্তির পর নমুনা সংগ্রহে বিলম্ব, রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে গড়িমসিসহ নানা অভিযোগ করেন স্বজনরা।
মৃত্যুর পর নমুনা সংগ্রহ আর পরীক্ষার পর অধিকাংশেরই ফলাফল নেগেটিভ আসায় অনেকেই বলছেন, আগে নমুনা সংগ্রহ করলে তাদের ক্ষোভ থাকতো না। প্রত্যেকেরই নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে মৃত্যুর পর। কারো কারো মৃত্যুর ৬ থেকে ১০ ঘণ্টা পর নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
এ পর্যন্ত করোনা ইউনিটেই ১০ রোগী মারা গেছেন। অন্যদের মৃত্যু হয়েছে বিভিন্ন ওয়ার্ডে। খুলনায় এ পর্যন্ত মৃত্যুবরণকারী ১৯ জনের মধ্যে ১৮ জনের ফলাফলই এসেছে নেগেটিভ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, জ্বর, সর্দি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে খুমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এলে তাকে প্রথম ফ্লু কর্নারের মাধ্যমে করোনা সাসপেকটেড আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। এছাড়াও আন্তঃ বিভাগে ভর্তি কোনো রোগীর যদি জ্বর, শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তাকেও এই ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তাদের করোনা পরীক্ষা পজেটিভ হলে ব্যবস্থা নেয় হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ।
গত ১ মে সন্ধ্যায় ফাতেমা নামে এক বছর বয়সী শিশুর মৃত্যু হয় করোনা সাসপেকটেড আইসোলেশন ওয়ার্ডে। নিউমোনিয়া সন্দেহে তাকে প্রথমে শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। পরে শ্বাসকষ্ট হলে আইসোলেশনে পাঠানো হয় করোনা পরীক্ষার জন্য। ততক্ষণে শিশুটির মৃত্যু হয়।
শিশুটির বাবা ইমদাদুল হক অভিযোগ করেন, তার মেয়ে শ্বাসকষ্টে ছটফট ও কান্নাকাটি করলেও কেউই কাছে আসেনি। অক্সিজেন লাগাতেও একবার ওয়ার্ডবয়, একবার নাসর্দের কাছে ধরনা দিতে হয়েছে। অনেক্ষক্ষণ পর একজন নার্স এসে অক্সিজেন লাগালে ততক্ষণে তার মেয়ে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এর অন্তত তিন ঘণ্টা পরে চিকিৎসক এসে মেয়েটিকে মৃত ঘোষণা করেন।
২২ এপ্রিল এই ওয়ার্ডে মারা যান ফুলতলা উপজেলার ৫২ বছর বয়সী মিজানুর হমান। রাতে শ্বাসকষ্ট নিয়ে সাসপেকটেড আইসোলেশন ওয়ার্ডে নেয়ার ঘণ্টা তিনেক পরে তার মৃত্যু হয়। পরিবারের অভিযোগ, মৃত্যুর আগে কোনো চিকিৎসক তাকে দেখেনি। করোনা সন্দেহে হাসপাতালের কেউ তার কাছে আসেননি। পরদিন দুপুরে তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
মিজানুর রহমানের ছেলে সাংবাদিকদের বলেন, বাবাকে প্রথম নগরীর ফরটিস এসকর্ট হাসপাতালে নিলে তারা শ্বাসকষ্ট দেখে খুমেক হাসপাতালে নিতে বলেন। কিন্তু এখানে আসার পর আমার বাবা বিনা চিকিসায় মারা গেছেন। করোনার গুজবে তার জানাজা দাফন হয় গোসল ছাড়া। পরে রিপোর্ট আসে আমার বাবার করোনা হয়নি।
১৯ মার্চ বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার বাবুল (৫২) নিজে হাসপাতালের বহির্বিভাগে আসেন। কিন্তু শ্বাসকষ্ট শুনে কেউ কাছে আসেনি। একবার বহির্বিভাগ, একবার জরুরি বিভাগ এভাবে করে চিকিৎসা না পেয়ে তিনি মারা যান।
২৯ মার্চ নড়াইলের টিপু সুলতান দুপুর দেড়টায় হাসপাতালে এলে রাত সাড়ে ৯টায় তার মৃত্যু হয়। পরিবারের অভিযোগ, মৃত্যুর সময় কোনো চিকিৎসককে তারা কাছে পাননি।
১০ এপ্রিল নগরীর খালিশপুর ক্রিসেন্ট জুটমিল এলাকার ৬ মাস বয়সী শিশু রাকাবের মৃত্যু হয় আইসোলেশন ওয়ার্ডে। রাকাবের বাবা বলেন, শিশু ওয়ার্ড থেকে বিকেল ৫টায় করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ডে আনার পরে কেউ তার সন্তানকে দেখতে আসেনি। রাত ১টার দিকে রাকাবের মৃত্যু হলেও ঘোষণা দেয়া হয় সকালে।
১৭ এপ্রিল রূপসা উপজেলার কাজদিয়া এলাকা থেকে ১০ বছর বয়সী মেয়ে মিতুকে নিয়ে তার বাবা হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করান। পরদিন সকালে সাড়ে ১০টায় আইসোলেশন ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হলে রাত সাড়ে ১১টায় তার মৃত্যু হয়।
মিতুর বাবা মাহাবুব জানান, রাতে আইসোলেশন ওয়ার্ডে কোনো চিকিৎসক ছিলেন না।
একই দিন এই ওয়ার্ডে মৃত্যু হয় নগরীর লবনচরা এলাকার আসাদুজ্জামানের।
পরদিন আইসোলেশন ওয়ার্ডে মারা যান পিরোজপুরে গৃহবধূ মাসুমা। মাসুমার স্বামী মোতালেব জানান, সিস্টার ও ওয়ার্ডবয়কে ডাকলেও কেউ কাছে আসেনি।
২৪ এপ্রিল মৃত্যু হয় বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার ১৬ বছর বয়সী ফাতেমার। ফাতেমার বাবা বিল্লার অভিযোগ, ঠিকমত চিকিৎসা তারা পাননি।
২৪ এপ্রিল আড়ংঘাটা এলাকা থেকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তিকে এই ওয়ার্ডে ভর্তি করে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও প্রশাসন। পরদিন এই ওয়ার্ডেই তার মৃত্যু হয়। হাসপাতাল সূত্র থেকে পরে জানা গেছে, এদের প্রত্যকেরই নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে এবং পরীক্ষা করোনা ধরা পড়েনি।
অভিযোগের ব্যাপারে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন) এবং করোনা সাসপেকটেড আইসোলেশন ইউনিটের মুখপাত্র ডা: শৈলেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, ২৪ ঘণ্টার রোস্টার করা চিকিৎসক রয়েছে। অধিকাংশ সময় দেখা গেছে, বিকেলে ভর্তির পর রাতেই রোগীর মৃত্যু হয়েছে। যেহেতু বিকেলে নমুনা সংগ্রহ করা হলেও পরদিন ছাড়া পরীক্ষার সুযোগ নেই, সে কারণে ওইদিন আর নমুনা সংগ্রহ করা হয় না। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে গিয়ে দেখা যায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। আবার কোনো কোনো চিকিৎসক নামাজে বা খেতে যেতে পারেন। তবে তিনি স্টেশনে থাকেন এবং চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সমন্বয়কারী এবং খুলনা মেডিক্যাল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা: মো: মেহেদী নেওয়াজ বলেন, করোনা সাসপেকটেড আইসোলেশন ওয়ার্ডের জন্য নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসক নেই। মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকরাই সেখানে গিয়ে ডিউটি করেন। এজন্য হয়তো সার্বক্ষণিক ডাক্তার পাওয়া যায় না। মেডিসিন ওয়ার্ডে যে চিকিৎসক দায়িত্বে থাকেন তারাই আইসোলেশন ওয়ার্ডে সেবা দেন। তারা ওই ওয়ার্ডে না থাকলে তার সংশ্লিষ্ট মেডিসিন ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালন করেন। তবে জরুরি প্রয়োজনে নার্সরা কল করলেই ডাক্তাররা সেখানে গিয়ে হাজির হন।