করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে খেটে খাওয়া দিনমজুর, কর্মহীন শ্রমজীবী ও নিম্নআয়ের মানুষেরা অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। দীর্ঘ দিন কাজ কারবার না থাকায় দিন আনে দিন খাওয়া গরিব মানুষ খাদ্যসঙ্কটে অসহায় হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার মানবেতর জীবনযাপন থেকে রক্ষা পেতে এখন সরকারি-বেসরকারি ত্রাণের ওপর ভরসা করছে। তাদের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের জন্য সরকার বরাদ্দ দিয়েছে ভিজিএফ, ভিজিডি ও ওএমএসের চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী। কিন্তু সেই গরিবের হকের ওপর হামলে পড়েছে কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। সাধারণ ছুটি শুরু হতে না হতেই ওই অসাধু দুষ্টচক্র গরিবের হক নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে থাকে। সরকার কঠোর অবস্থানে থাকার পরেও একের এক অনিয়ম ও দুর্নীতি লেগেই আছে। ছৃটির চল্লিশ দিন পার হলেও দেশের বিভিন্ন ইউনিয়নে অসহায় দুস্থ মানুষের হকের ওপর থাবা যেন থামছেই না। গরিবের চাল লুটেপুটে খাচ্ছে অসাধু জনপ্রতিনিধিরা। গত বৃহস্পতিবারও জেলেদের ভিজিএফের চাল আত্মসাতের অভিযোগে এক ইউপি চেয়ারম্যান ও দুই মেম্বারকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।
রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মাত্রাতিরিক্ত স্বেচ্ছাচারিতা দেখা দিয়েছে। কোথাও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। বিভিন্ন অঙ্গনে দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বালিশকাণ্ড ও পর্দাকাণ্ডের মতো বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা উন্মোচিত হলেও এর সঠিক কোনো বিচার এখনো পর্যন্ত হয়নি। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে অনেকেই পার পেয়ে যাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে অপরাধীরা অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। যার ফলে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নেও অসাধু জনপ্রতিনিধিরা গরিবের হক লুটেপুটে খাচ্ছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মৎস্যখাতে ভিজিএফর চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার কুচাইপট্টি ইউপির চেয়ারম্যান বি এম নাসির উদ্দিন স্বপন ও ৩ নং ওয়ার্ডের সদস্য মো: মোফাজ্জেল ব্যাপারী এবং ৯ নং ওয়ার্ডের সদস্য শামীম বেপারীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত মোট ৫২ জন জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৯ জন ইউপি চেয়ারম্যান, ৩১ জন ইউপি সদস্য, ১ জন জেলা পরিষদ সদস্য এবং ১ জন পৌরসভার কাউন্সিলর। এ ছাড়া টিসিবির তেল কালোবাজারে বিক্রির অভিযোগে র্যাবের হাতে ধরা খেয়েছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আইনুল ইসলাম। তার মতো অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ভিজিডি, ভিজিএফ ও ওএমএসসহ ত্রাণের চাল আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগে অনেকেই দল থেকেও বহিষ্কার হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশের এই পরিস্থিতিতে গরিবের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি চাল আত্মসাতের ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এ ধরনের ঘটনার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বাররা দায়ী তো আছে, এর সাথে সরকারও কম দায়ী নয়। কারণ জনপ্রতিনিধি হতে এখন তো নির্বাচন লাগে না। সরকারি সিদ্ধান্তে হয়। এতে ভালো মানুষ বাদ দিয়ে খারাপ মানুষকে সিলেকশন করা হয়। এখন খারাপ মানুষ তো খারাপ কাজ করবে। তিনি আরো বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদে আগের মনোনয়ন ব্যবস্থা বাতিল করে এখন দলীয় ভিত্তিতে মনোনয়ন দেয়া হয়। সবাই দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য তদবির করে। তারা জানে, দলীয় মনোনয়ন পেলেই চেয়ারম্যান হওয়া যাবে। তাহলে কেন তারা নির্বাচনের দিকে চেয়ে থাকবে! যার কারণে জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতাও নেই। ইউনিয়ন পরিষদ হলো একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান অথচ এই প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, এসবের কারণের একটি হলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। এর কারণে জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতাও নেই। বিচারের আইনি প্রক্রিয়াটা খুব শ্লথ। যারা এগুলো করছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা আমরা করতে পারিনি। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে যদি শাস্তির ব্যবস্থা করা যেত তাহলে সবার মনে একটি ভয় তৈরি হতো। তখন দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ত না। এখন বিচার হয় না। আরেকটি হলো রাজনৈতিক পরিস্থিতি। যারা এগুলো করছে তারা মনে করে তাদের তো বড় বস আছে। ফলে তারা ধরেই নিয়েছে, যা কিছু করুক না কেন তাদের কোনো বিচার হবে না। ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, এখন দেশে একটা সঙ্কট চলছে। এই সঙ্কটের মধ্যে এ ধরনের চাল চুরি, গম চুরিকে খুবই জঘন্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত। প্রয়োজন হলে আইনকে আরো শক্তিশালী করা উচিত। তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে এই প্রবণতা বন্ধ করা উচিত। সূত্র: নয়া দিগন্ত