আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বিশাল অঙ্কের প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার ঘাটতিব্যয় ধরা হয়েছে। এ বিশাল অঙ্কের ঘাটতিবাজেটে অর্থায়নে যেসব উৎসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার বেশির ভাগ অর্জন হবে না বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে কাঙ্ক্ষিত হারে ঋণ না পেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই বেশি মাত্রায় ঋণ নিতে হবে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তা অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না। যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারে তবে উভয় সঙ্কটে পড়বে দেশ। এ জন্য বাজেট ঘাটতি কমাতে অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো: আজিজুল ইসলাম রোববার জানিয়েছেন, অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় অর্থনীতির ওপর চাপ বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে যেসব উৎসের কথা বলা হয়েছে তার বেশির ভাগই অর্জন হবে না। বিশেষ করে ব্যাংক খাত সরকারের বেশি মাত্রায় ঋণের জোগান দিতে পারবে না। কারণ, ব্যাংক খাত থেকে সরকার বেশি মাত্রায় ঋণ নিলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য বেসরকারি খাতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হওয়া দরকার তা হবে না। নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন না হলে বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। এতে করোনার কারণে মানুষ যে হারে কাজ হারাচ্ছেন তাদের কর্মক্ষেত্র থাকবে না। এতে বেকারত্বের হার আরো বেড়ে যাবে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের ব্যাংক খাত থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নেয়া মোটেও ঠিক হবে না। ঘাটতিবাজেট কমাতে সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হবে। এরপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপানোর প্রয়োজন হলে তার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন রোববার বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের আয় কমে গেছে। তারা এখন আর সঞ্চয় করতে পারছে না। বরং অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। এমনি পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সঞ্চয়পত্র থেকে যে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জন হবে না। আবার ব্যাংক খাতের অবস্থাও ভালো নয়। বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক খাত থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা ব্যাংকারদের সদিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাওয়ায় ও ব্যক্তি পর্যায়ে ঋণের চাপ থাকায় শেষ মুহূর্তে ব্যাংক খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অর্থ পাবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপাতে হবে। ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রী ইঙ্গিতও করেছেন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে অর্থের জোগান দেয়া মোটেও ভালো হবে না।
তিনি মনে করেন, মুদ্রা সরবরাহ বাড়লে আর্থিক খাতের ক্ষতি হবে, মুদ্রাবাজারের ঝুঁকি বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে তার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে আমও যাবে, ছালাও যাবে। তিনি মনে করেন, অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা খাত ও দরিদ্রদের পেছনে যে ব্যয় করার কর্মপরিপকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক এ মুখ্য অর্থনীতিবিদ মনে করেন, অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন খাতে যে ব্যয় ধরা হয়েছে তা কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রসঙ্গত, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বিশাল ঘাটতিবাজেট দেয়া হয়েছে। এ বিশাল ঘাটতিবাজেটের মধ্যে বিদেশী উৎস থেকে ৭৬ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা এবং বাকি অর্থ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ৮৫ হাজার কোটি টাকাই ব্যাংক খাত থেকে এবং ২০ হাজার কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ৪৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় ও সঞ্চয়পত্র থেকে কাক্সিক্ষত হারে ঋণ না পাওয়ায় ব্যাংক খাত থেকে প্রায় দ্বিগুণ ঋণ নিতে হচ্ছে চলতি অর্থবছরের জন্য।