কৃষিকার্যক্রম বা চাষাবাদকে আধুনিকীকরণ না করার ফলে চাষাবাদে অধিক সময় ও অর্থ বেশি ব্যয় হচ্ছে। এ সময় ও অর্থ সাশ্রয়ে সরকার তিন হাজার ১৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প নিচ্ছে। আর কিভাবে এ সময় ও অর্থ সাশ্রয় করা যায় সেটার প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাসফরে বিভিন্ন পর্যায়ের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা বিদেশ যাবেন। যাদের পেছনেই খরচ হবে প্রায় ৮ কোটি টাকা। মাথাপিছু ৩ লাখ টাকা। প্রকল্পটির সমীক্ষা দেশব্যাপী না হওয়ায় এ নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন প্রশ্ন তুলেছে। পাশাপাশি আগের দু’টি প্রকল্পে অভিজ্ঞতা অর্জনের পরও মাসে ৯ লাখ টাকা হারে সাড়ে ৫ কোটি টাকায় তিনজন পরামর্শক নিয়োগেও কমিশন আপত্তি তুলেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্পোন্নয়নের কারণে মানুষ এখন আর কৃষিশ্রমিকের মতো পরিশ্রম করতে চায় না। ফলে মওসুমের সময় কৃষিশ্রমিক পাওয়া যায় না। এতে ধান রোপণ ও কাটার সময় শ্রমিকের মজুরি অনেক বৃদ্ধি পায়; যা কৃষকের উৎপাদন খরচ ও সময় বৃদ্ধি করে। ফলে কৃষি দিনদিন অলাভজনক হয়ে উঠছে। চীনসহ বিশ্বের উন্নত দেশে কৃষিকাজে রোবট, ড্রোন, সেন্সর ও কৃত্রিম বুদ্ধিচালিত যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছে। তাই কৃষিব্যয় কমাতে এবং উৎপাদন বাড়াতে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ অপরিহার্য। এর জন্য তিন হাজার ১৯৮ কোটি ৫২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। কৃষিশ্রমিকের অভাবে শ্রমের মজুরি বেশি হওয়াতে উৎপাদন খরচ ও সময় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে অলাভজনক হচ্ছে কৃষি। তাই তৃতীয় প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষিতে ৫৭ হাজার ২৫০টি বিভিন্ন ধরনেরই যন্ত্রপাতি যুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পাঠানো প্রস্তাবনা অনুযায়ী, সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে এ প্রকল্পটি আগামী পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন করা হবে। ৬৪টি জেলার সব উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও প্রকল্পটি সমীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ২৬ জেলার ৫২ উপজেলায়। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া নতুন অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকায়ও রয়েছে। এর আগেও একই লক্ষ্যে দু’টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১২ সালে খামার যান্ত্রিকীকরণ নামে প্রকল্পে ব্যয় করা হয় ১৫০ কোটি টাকা। আর জুলাই ২০১৩ সাল থেকে জুন ২০১৯ সাল সময় পর্যন্ত দ্বিতীয় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয় ৩৩৯ কোটি টাকায়। নতুন এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২৮ দিনব্যাপী ৯ হাজার গ্রামীণ মেকানিক প্রশিক্ষণ, ৫ দিনব্যাপী ১৫ হাজার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ, এক হাজার কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ, ৩০ হাজার যৌথভাবে জমি ব্যবহারকারী কৃষক বা উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ, এক হাজার ৪৪০ জন যন্ত্র উপযোগী ধানের চারা উৎপাদন কৌশল প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ ২শ’টি, ১৯৭টি কৃষিমেলা, সমন্বিত খামারে ১২শ’ ৪০ মেট্রিক টন বীজ সহায়তা প্রদান করা হবে। এ ছাড়াও রয়েছে ৪৩টি কর্মশালা, ১৮টি প্রশিক্ষণ ভবন ও ডরমেটরি নির্মাণ, একটি কৃষি যন্ত্রপাতি টেস্টিং ও প্রশিক্ষণ সেন্টার সুবিধা বৃদ্ধি, একটি টেস্টিং শেড নির্মাণ এবং ৩শ’টি উপকরণ সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা।
প্রস্তাবনা ব্যয়ের হিসাব থেকে জানা যায়, ৫৭ হাজার ২৫০টি বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি কেনা হবে। তাতে খরচ হবে ২ হাজার ৭১৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা; যা মোট প্রকল্প খরচের ৬৮ শতাংশ। এর মধ্যে ধান ও গমের জন্য ১৫ হাজার, ভুট্টার জন্য ৫শ’টিসহ মোট সাড়ে ১৫ হাজার কম্বাইন্ড হারভেস্টার। এতে ব্যয় হবে ২ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। ৯ হাজার রিপার ও রিপার বাইন্ডারের জন্য ১১৯ কোটি টাকা, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ৫ হাজারটি কিনতে ২২৬ কোটি টাকা, ৫ হাজারটি ব্লেড প্লান্টার ৫৬ কোটি টাকা, ৫ হাজারটি পাওয়ার স্পেয়ার ৫২ কোটি ২০ লাখ টাকা। ৫ হাজারটি মেইজ শেলার ৩৭ কেটি ৭০ লাখ টাকা, ৫ হাজারটি ড্রায়ার ৮১ কোটি টাকা, ৩ হাজারটি পটেটো ডিগার কিনতে ৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় হবে।
আগে দু’টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পরও এখন আবার তিনজন পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। যাদের পেছনে খরচ হবে ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। প্রতি মাসে পরামর্শক খাতে ব্যয় ৯ লাখ টাকা। এ বিষয়টি বাদ দেয়ার জন্য কমিশন থেকে বলা হয়েছে। ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্মকর্তারা বিদেশে শিক্ষাসফর করবেন। যন্ত্রপাতি সম্পর্কে জানতে বিদেশে প্রশিক্ষণ নেবেন ৫০ জন। এর জন্য ব্যয় হবে দেড় কোটি টাকা।
কমিশনের কৃষি উইং বলছে, পরিপত্র অনুযায়ী সম্ভাব্যতা যাচাই করেই প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র ২৬ জেলার ৫২ উপজেলার তথ্যাদির ভিত্তিতে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। ফলে সমীক্ষায় সারা দেশের প্রতিটি উপজেলার তথ্যাদি সঠিকভাবে উঠে আসেনি। প্রথম পর্যায়ের প্রকল্পে ৩৮ হাজার ৩৩৮টি বিভিন্ন প্রকারের যন্ত্রপাতি খামারিদের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের মাধমে ২৫ হাজার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কৃষকদের সরবরাহ করা হয়েছে। সমাপ্ত দুই প্রকল্পে আইএমইডির কোনো মূল্যায়ন হয়েছে কি না তা স্পষ্ট না। কারণ ওই ধরনের কোনো প্রতিবেদন ডিপিপিতে যুক্ত করা হয়নি।
এ ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মো: জাকির হোসেন আকন্দের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পকে সরকার এখন বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে। প্রকল্পটির ব্যয়ের খাত নিয়ে বিশ্লেষণ করা হবে। মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটি দেরিতে এসেছে। কৃষির আধুনিকায়নে এখন এ ধরনের প্রকল্প জরুরি।