নারায়ণগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্বে আছেন ডাক্তার শিল্পি আক্তার। নারায়ণগঞ্জে করোনা আক্রান্তদের নিয়মিত চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। করোনার নমুনা পরীক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। মানুষের সেবা দিতে গিয়ে তিনি নিয়মিত বাসায় আসতে পারতেন না। তাই লকডাউনের মধ্যে ফতুল্লার দেলপাড়া এলাকা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বোনের জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে যেতো ডাক্তার শিল্পির ছোট ভাই আনিস। হঠাৎ করে আনিস অসুস্থ হয়ে পড়লে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর করোনা পজেটিভ হয়।
কোনো উপসর্গ না থাকলেও কৌতুহলবশত ডাক্তার শিল্পী নিজেরসহ পুরো পরিবারের করোনা পরীক্ষা করান। ২৭ এপ্রিল রাতে ডাক্তার শিল্পী ছাড়া পুরো পরিবারের করোনা পজেটিভ আসে। ২৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদা বারিক দেলপাড়া এলাকায় গিয়ে ডাক্তার পরিবারের ১৮ সদস্যকে বাসায় আইসোলেশনের রাখার নির্দেশ দিয়ে বাড়িটি লকডাউন করে দেন।
এদিকে, ডাক্তার শিল্পির পরিবারের ১৮ সদস্য একযোগে করোনায় আক্রান্তের খবরে এলাকায় তোলপাড় শুধু হয়। এই প্রথম ওই এলাকা আক্রান্ত হওয়ায় এবং একই পরিবারের একসাথে ১৮ জন সদস্য আক্রান্ত হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এরই মধ্যে এলাকার একটি পক্ষ অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে বাধা দেয় এবং আক্রান্তদের এলাকা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে দাবি তোলে। প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপে তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় সন্ধ্যার দিকে একদল উচ্ছৃঙ্খল লোক ডাক্তার শিল্পীর বাড়ির সামনে গিয়ে গালিগালাজ এবং ঢিল ছুড়ে। খবর পেয়ে ফতুল্লা থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরির্দশন করে ডাক্তার পরিবারকে হয়রানী না করার জন্য কঠোর বার্তা দিয়ে আসেন।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সিভিল সার্জন কার্যালয়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: শিল্পী আক্তার নমুনা সংগ্রহের কাজ করছেন। তার পিত্রালয়ের (যৌথ পরিবার) ১৮ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে শিল্পী আক্তারের বাবা, মা, ভাই, বোন, চাচাও রয়েছেন। তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭৪ বছর বয়সী বৃদ্ধ এবং ১৪ বছর বয়সী কিশোরও রয়েছে। তবে শিল্পী আক্তারের নিজের করোনা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ এসেছে।
যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: শিল্পী আক্তার জানান, সিভিল সার্জন অফিসে তার জন্য খাবার দিয়ে যেতেন তার ছোট ভাই। হঠাৎ ছোট ভাই অসুস্থ হয়ে পড়লে তার করোনা পরীক্ষা করা হয়। গত ২১ এপ্রিল ফলাফলে করোনা পজেটিভ আসে তার। পরিবারের অন্য কারোর কোনো উপসর্গ না থাকলেও সন্দেহবশত গত ২৩ এপ্রিল বাকি ১৮ সদস্যেরও নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সাত বছরের এক শিশু ছাড়া পরিবারের ১৭ জনেরই করোনা পজেটিভ আসে।
শিল্পী আক্তার বলেন, আমার বাবার বাড়ির পরিবারের ১৮ জনই করোনা পজেটিভ। তবে তাদের কোনো উপসর্গ নেই। প্রথম ছোট ভাইয়ের পজেটিভ পাওয়াতে বাকিদের পরীক্ষা করিয়েছিলাম। সকলেই বাড়িতে আইসোলেশনে আছে।
বাড়িতে ইটপাকেল নিক্ষেপের ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ডাক্তার শিল্পী বলেন, মঙ্গলাবার সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে কে বা কারা যেন ঢিল ছুঁড়েছে। বিষয়টি আমি প্রশাসনে জানিয়েছি। থানা পুলিশও এসে ঘুরে গিয়েছে। আমাকে প্রশাসন থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে পুলিশ এবং সেনাবাহিনী নিয়মিত এখানে আসা-যাওয়া করবে।
তিনি বলেন, এমনিতে ১৮ জন আক্রান্ত হয়েছে। তাদের মানসিক অবস্থা ভালো নয়। এখন তাদের সাপোর্ট দরকার। সহমর্মিতা দরকার। অথচ এলাকাতে হচ্ছে উল্টোটা। আমরা এখানকার স্থানীয়। তারপরও এই মানুষগুলো কেন এমন করছে বুঝতে পারছি না। তাছাড়া আমাদের বাড়িটি আগের থেকেই লকডাউন করেছি। কাউকে এখান থেকে বের হতে দিই না। বাইরে থেকেও কেউ ভেতরে আসতে পারে না। তারপরেও আমাদেরকে উৎখাতের চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, বাড়িতে রেখে তাদের চিকিৎসা করানো হচ্ছে। অন্য চিকিৎসকেরাও এসে দেখেও গেছেন। সার্বক্ষণিক আমি এখানে আসা-যাওয়া করবো। আবার অফিসিয়াল কাজও করবো। এই বাড়ির লোক বের না হলে ভাইরাসটি অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত হাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তারপরও স্থানীয়দের কেউ কেউ হয়তো ভুল বুঝিয়ে সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদা বারিক জানান, পরিস্থিতি এখন ঠিক আছে। ওই মেডিকেল অফিসার নিজেই তার পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা করছেন। তাদের বাসায় সাত বছর বয়সের একটি শিশু ছাড়া ১৭ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। তাদেরকে ধৈর্য ধরে চিকিৎসা নেয়ার জন্য অনুরোধ করেছি। উচ্ছৃঙ্খল লোকজনদের ধাওয়া করা হয়েছে। ডাক্তার পরিবারের সার্বিক বিষয় আমরা খোঁজখবর রাখছি।