প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি) নেয়া হবে। মহামারীর প্রকোপ কমলে সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে। সেটা সম্ভব হলে ডিসেম্বরে নেয়া হবে পিইসি পরীক্ষা। ছুটি বেড়ে গেলে শিক্ষাবর্ষ দুই মাস বাড়ানো হবে। সেক্ষেত্রে পিইসি এবং বার্ষিক পরীক্ষা উভয়ই পেছাবে।
সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার পরিকল্পনা আছে। এ লক্ষ্যে সিলেবাস পর্যালোচনার কাজ চলছে।
সোমবার এডুকেশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ইরাব) আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় সরকারের এ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী। সংগঠনের সভাপতি মুসতাক আহমদের সভাপতিত্বে এতে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আকরাম-আল হোসেন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ।
ইরাবের সাধারণ সম্পাদক নিজামুল হকের সঞ্চালনায় এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সিনিয়র সদস্য সাব্বির নেওয়াজ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক মীর মোহাম্মদ জসিম। আলোচনায় আরও অংশ নেন- ঝালকাঠির কীর্তিপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিমুল সুলতানা হ্যাপী, রাজধানীর একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক রাশেদ রাব্বী, রংপুর ক্যাডেট কলেজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রওশন আরা, ইরাব কোষাধ্যক্ষ শরীফুল আলম সুমন, যুগ্ম সম্পাদক ফারুক হোসাইন, দফতর সম্পাদক এমএইচ রবিন, ডেইলি স্টারের সিনিয়র রিপোর্টার মহিউদ্দীন জুয়েল, রাইজিং বিডির স্টাফ রিপোর্টার এবিএস ইয়ামিন, মানবজমিনের স্টাফ রিপোর্টার পিয়াস সরকার।
করোনায় প্রাথমিক শিক্ষায় চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক এ সেমিনারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বন্ধের কোনো পরিকল্পনা আপাতত সরকারের নেই। বরং এ পরীক্ষা আরও যুগোপযোগী করতে একটি বোর্ড গঠনের চিন্তাভাবনা চলছে।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি অনুকূল হলে ও সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা গেলে শিক্ষাবর্ষের ব্যাপ্তি আর না বাড়িয়ে ডিসেম্বরেই শেষ করা হবে। আর প্রয়োজন হলে চলতি শিক্ষাবর্ষ বাড়িয়ে এবং পরের শিক্ষাবর্ষ কমিয়ে আনার পরিকল্পনাও রাখা হয়েছে। সেক্ষেত্রে বর্তমান শিক্ষাবর্ষ আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এটা নির্ভর করবে করোনা পরিস্থিতির ওপর।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যালয় খোলার পর কতটুক সিলেবাসের ওপর পরীক্ষা নেয়া হবে সেই পরিকল্পনা করা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর এবং জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমিকে (নেপ) সংশোধিত সিলেবাস তৈরির কাজ দেয়া হয়েছে। স্কুল খোলার পর কতগুলো ক্লাস নেয়ার সুযোগ থাকবে, তার ওপর ভিত্তি করে সংশোধিত সিলেবাস তৈরি করা হবে। এক্ষেত্রে পরের শ্রেণির সঙ্গে যেসব পাঠ বেশি গুরুত্বপূর্ণভাবে যুক্ত আছে, সেগুলো চিহ্নিত করে সংশোধিত সিলেবাস তৈরির নির্দেশনা আমরা দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের শ্রেণিভিত্তিক মৌলিক জ্ঞান ও সক্ষমতা অর্জনের বিষয়টির সঙ্গে আপোস করা হবে না।
সিনিয়র সচিব মো. আকরাম আল হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ব্যাপারটি বিবেচনা করেই স্কুল খোলা হবে। তবে আমরা আশা করছি, আগামী সেপ্টেম্বরে স্কুল খুলতে পারব। পরীক্ষা নয় আমরা শিশুদের মূল্যায়ন নিয়ে ভাবছি। কীভাবে ও কতটুকু পড়িয়ে পরবর্তী ক্লাসে পদোন্নতি দেয়া যায় সে বিষয়টি বিবেচনা করে সিলেবাস পর্যালোচনা করা হচ্ছে। টিভির পাশাপাশি আগামী দুই-এক সপ্তাহের মধ্যে প্রাথমিকের ক্লাস রেডিওর মাধ্যমে প্রচার শুরু করা হবে। রেডিওর মাধ্যমে পাঠদান শুরু করতে পারলে আমরা ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে যাব। এছাড়া শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে পাঁচ মিনিট ফোনে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে পারবে সেই কর্মসূচিও নেয়া হয়েছে। করোনাপরবর্তী সময়ে ঝরেপড়া রোধে আমাদের বেশকিছু পরিকল্পনা রয়েছে। স্কুল মিল চালুর জন্য ১৯ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেয়া হয়েছে। উপবৃত্তি প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধি করা হয়েছে।
সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, করোনাকালে শিক্ষায় বৈষম্য বাড়ছে। টেলিভিশনের ক্লাস সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে না। ক্লাসগুলো দিন দিন আকর্ষণ হারাচ্ছে। কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো সত্যিকার অর্থেই বিপদে আছে। তাদের জন্য বিনাসুদে ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বন্যাদুর্গত এলাকার শিশুদের নিয়ে বিশেষভাবে ভাবতে হবে। ইন্টারনেটের ওপর থেকে অতিরিক্ত ভ্যাট-ট্যাক্স প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, ইন্টারনেটের ওপর করের বোঝা কেন আরোপ করা হল? কোন অদৃশ্য কারণে এটা প্রত্যাহার করা হল না? অবিলম্বে এটা প্রত্যাহারের দাবি করছি, নইলে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ রাখা সম্ভব না। অনলাইন ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ কীভাবে গড়ব?
মো. ফসিউল্লাহ বলেন, টেলিভিশনে প্রচারিত ক্লাস ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী দেখছে। তবে সব শিক্ষার্থীকে অনলাইন ক্লাসের আওতায় আনতে আমরা খুব শিগগিরই রেডিওতে ক্লাস প্রচার শুরু করব। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও অনলাইনে শুরু হতে যাচ্ছে।
অভিভাবক রাশেদ রাব্বি বলেন, টেলিভিশনের পাঠদানের সিদ্ধান্তটি খুবই যুগোপযোগী। তবে এটি খুব বেশি কাজে আসছে বলে আমার মনে হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, ক্লাসের কোনো ধারাবাহিকতা ও নির্দিষ্ট রুটিন নেই। এটা না থাকায় শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পাঠ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই ক্লাস সম্প্রচার করা হয় যেই টেলিভিশনে সেটার শব্দ ও ছবির মান অত্যাধিক নিম্নমানের। অন্যদিকে প্রাথমিকের পরীক্ষা নেয়ার কথা বলা হচ্ছে মায়েদের মাধ্যমে। তবে সব মা পরীক্ষা নেয়ার জন্য উপযুক্ত নন। এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার দায় দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
ঝালকাঠি কীর্তিপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিমুল সুলতানা হ্যাপি বলেন, আসলে বলতে গেলে গৃহবন্দি পরিবেশে শিশুদের মানসিক বিকাশ হয় না। তাদের মানসিক বিকাশে আমরা কাজ করছি। টেলিভিশনের পাঠদান স্থানীয়ভাবে ক্যাবল টিভিতে সম্প্রচারের উদ্যোগ নিলে তা অনেক বেশি শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছবে।
রংপুর ক্যাডেট কলেজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রওশন আরা বলেন, স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী পরিবারের জন্য বিভিন্ন ধরনের কাজে যুক্ত হয়েছে। তাদের পড়াশোনার ধারাবাহিকতা নিয়ে আসা এখন চ্যালেঞ্জ। অনলাইনে পাঠদান তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানো কষ্টকর হয়ে পড়ছে।