সুপার ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছে বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে।
রোববার সন্ধ্যায় আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পশ্চিম মধ্যবঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে।
ঘূর্ণিঝড়টি রোববার সন্ধ্যা ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৩০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল।
বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে আবহাওয়া অফিস জানায়, এটি আরও উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে খুলনা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে আগামীকাল বুধবার বিকেলে বা সন্ধ্যার মধ্যে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৬০ সাল থেকে ২০০৭ সালে সিডরের পর্যন্ত বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়গুলোকে ‘সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম’ বা প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০০৭ সালে প্রথম স্পষ্ট নামকরণ করা হয়। ২২৩ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা এবং ১৫-২০ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসে নিয়ে আসা সেই ঘূর্ণিঝড় ছিল সিডর যাকে সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম উইথ কোর অব হারিকেন উইন্ডস (সিডর) নাম দেয়া হয়।
সবচেয়ে ভয়াবহ ৫টি ঘূর্ণিঝড়
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে বিবেচনা করা হয় ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়কে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক শাহ আলম বলেন, সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ছিল ১৯৭০ এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়। এরপরে তিনি সাইক্লোন সিডরের কথা উল্লেখ করেন।
১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড়: ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর সবোর্চ্চ ২২৪ কিলোমিটার বেগে চট্টগ্রামে আঘাত হানা এই প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ১০-৩৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল।
যে হিসেব পাওয়া যায় তাতে ১৯৭০ এর সালের প্রবলতম ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখ মানুষ নিহত হয়। সেসময় ১০-৩৩ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল এবং অসংখ্য গবাদি পশু এবং ঘরবাড়ি ডুবে যায়।
সাবেক পরিচালক শাহ আলম বলেন, অনেকে মনে করেন মৃতের সংখ্যা আসলে ৫ লাখেরও বেশি ছিল।
তিনি বলেন, “৭০ এর সাইক্লোন থেকেই মূলত মোটামুটিভাবে মনিটর করা শুরু হয়। সেই ঘূর্ণিঝড়টা সরাসরি বরিশালের মাঝখান দিয়ে উঠে আসে। ভোলাসহ অনেক এলাকা পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।”
১৯৮৫ সালের ঘূর্ণিঝড়: উরিরচরের ঘূর্ণিঝড় নামে পরিচিত এই সাইক্লোনটি যার বাতাসের গতিবেগ ছিল ১৫৪ কিলোমিটার। আলম বলেন, “এটা অল্প জায়গায় হয়েছে ফলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি ছিল না”।
১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়: নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে এই ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ১২-২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ঘূর্ণিঝড়টিতে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ২২৫ কিলোমিটার।
১৯৯১ সালের ২৯-৩০ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়কে আখ্যা দেয়া হয় ‘শতাব্দীর প্রচণ্ডতম ঘূর্ণিঝড়’ হিসেবে যাতে ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায় বলে জানা যায়। যদিও বেসরকারি সংগঠনের দাবি অনেক মাছধরার ট্রলার সাগরে ডুবে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন আরও অনেকে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় এক কোটি মানুষ।
আবহাওয়া বিভাগের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, “এই সাইক্লোনে অনেক পানি হয়েছিল। অনেক মানুষ মারাও গিয়েছে। যদিও পূর্বাভাস ভালো ছিল, ২৭ ঘণ্টা আগে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ৬ ঘণ্টা ধরে স্থলভাগে আসে এবং তাণ্ডব চালায় এই সাইক্লোনটি।”
তিনি বলেন, “সাধারণত ২/৩ ঘণ্টার বেশি সাইক্লোন থাকে না। কিন্তু এটি ছয়-ঘণ্টার বেশি সময় বাতাস বইতে থাকে”।
শাহ আলম জানান, ২২৪ কিলোমিটার বেগে আসা এই ঘূর্ণিঝড়ে তেলের ট্যাংকার পর্যন্ত ওপরে উঠে গিয়েছিল।
ঘূর্ণিঝড় সিডর: ২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় ১৫-২০ ফুট উচ্চতার প্রবল ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানে যার বাতাসের গতিবেগ ছিল ২২৩ কিলোমিটার।
জোয়ারের সময় হয়নি বলে প্লাবন কম হয়েছে, ফলে তুলনামূলক মানুষ কম মারা গেছে, কিন্তু অবকাঠামোগত অনেক ক্ষতি হয়েছে, বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সিডরে রেডক্রসে হিসেবে ১০ হাজার মারা গেছে বলা হলেও সরকারিভাবে ৬ ছয় হাজার বলা হয়েছিল।
ঘূর্ণিঝড় আইলা: ২০০৯ সালের ২৫শে মে পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানা প্রবল ঘূর্ণিঝড় আইলা, যার বাতাসের গতিবেগ ছিল ৭০-৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত।
আলম বলেন, “বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ‘৭০ এবং ৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে”।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞের চোখে
বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে দুর্যোগ ফোরাম। এই সংগঠনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহর নাইম ওয়ারা বলেন, মানুষ বাতাসকে ভয় পায়না, ভয় পায় পানিকে। আর জোয়ারের সময় ঘূর্ণিঝড় হলে তা বিশাল রূপ নেয়। ৭০ এবং ৯১ সময় সেটাই হয়েছিল।
তবে তিনি মনে করেন, ক্ষয়ক্ষতির চিত্রটি সবসময় পূর্ণাঙ্গভাবে উঠে আসেনা। । “কারণ তখন তথ্য সংরক্ষণের ততটা ব্যবস্থা ছিলনা। তাছাড়া কর্তৃপক্ষ ডেডবডি কাউন্ট করে, সরকার ডেডবডি না পেলে মৃত হিসেবে লিপিবদ্ধ করে না। সাগরে যারা হারিয়ে গেছে তাদের হিসাব তো করা হয় না।”
”সিডরে ১০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল বলেছিল রেডক্রস। কিন্তু সরকার বলেছিল ৬ হাজার। সুতরাং ক্ষয়ক্ষতির হিসাব সবসময় ঠিকভাবে উঠে আসেনা”।
তিনি বলেন “আইলাতে কম মানুষ মারা গিয়েছিল, দিনের বেলায় হওয়াতে অনেকে সরে যেতে পেরেছিল। কিন্তু আইলার ক্ষতি এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। শুধু মানুষ না পশু-প্রাণীর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল”।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়
সূত্র : বিবিসি