বাসা ভাড়া নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন ঢাকা শহরের খেটে খাওয়া ও নিম্ন আয়ের মানুষ। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের মধ্যে অফিস আদালত, ব্যবসা বাণিজ্যসহ আয়ের সব পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ‘দিন আনে দিন খাওয়া’ ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এমনিতেই পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে রাজধানীর নিম্ন আয়ের মানুষ। তার ওপর বাসা ভাড়ার খড়গ তাদের জীবনের ওপর যেন পাহাড়সম বোঝা চাপিয়ে দেয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। দেশের এই পরিস্থিতিতে অন্তত তিন মাসের বাসা ভাড়া মওকুফের দাবি সংশ্লিষ্টদের।
জানা গেছে, ঢাকা শহরে ৬৪ জেলার দুই কোটি মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ১০ শতাংশের মতো মানুষের নিজস্ব বাড়ি বা ফ্লাট আছে। যাদের ভাড়া গুণতে হয় না। আর ৯০ শতাংশ মানুষ অর্থ্যাৎ এক কোটি ৮০ লাখ মানুষ বাসা ভাড়া দিয়ে রাজধানীতে বসবাস করে থাকেন। এরমধ্যে বাসা ভাড়া দেয়ার সামর্থ্য আছে এক কোটি ৩০ লাখ মানুষের। বাকি ৫০ লাখ মানুষ একেবারে কোনোমতে জীবনযাপন করে থাকে। এরমধ্যে রয়েছে দিন আনে দিন খাওয়া মানুষ, বস্তিবাসী, নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ, কিছু গরিব অসহায় ব্যাচেলর যাদের পড়ালেখাসহ বাসা ভাড়া টিউশনির ওপর নির্ভরশীলসহ অনেকেই। এই মানুষগুলোর জীবনের চাকা ঘুরে প্রতিদিনের আয়ে, কারো চলে সপ্তাহের রোজগারে, আবার কারো চলে মাসের বেতনের ওপর। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ওই মানুষগুলোর সব দরজা আপাতত বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার ও কর্মহীন হয়ে জীবনযাপন করছেন তারা। তেমনই একজন পিকুল হোসেন। আটজন বন্ধু মিলে ১৮ হাজার টাকা দিয়ে তিন রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন রাজধানীর মালিবাগে। সবাই লেখাপড়া করেন রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তাদের সবাই টিউশনি করে চলেন। তাদের পরিবারে কারো কারো পিতাও নেই। টিউশনিই তাদের একমাত্র সম্বল। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সবাই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
পিকুল জানান, ‘কী বলব আর দুঃখের কথা, পড়ালেখা শেষ হয়েছে চাকরির আশায় পড়াশোনা করছি। কয়েকটা টিউশনি করে যা পাই তা দিয়ে বাসাভাড়া, খাবারের বিলসহ অন্যান্য খরচ কোনোমতে চালাতে পারি। যে মাসে কোনো কারণে টিউশনি একটা চলে যায় ওই মাসে বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নিয়ে চলতে হয়। এখন এই করোনাভাইরাস শুরু হয়েছে, কোনো টিউশনি নেই। আতঙ্কে সকলেই না করে দিয়েছে। এখন কেমনে চলবো, আর বাসা ভাড়া কিভাবে দেবো, চিন্তায় আছি। একটি বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক শরিফুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। তিনি সাড়ে ৬ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দেন এবং গ্যাস বিদ্যুৎসহ অন্যান্য খরচ মিলে সাড়ে আট হাজার টাকার মতো বাসা ভাড়াবাবদ খরচ হয়। তিনি বলেন, বেসরকারি স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের বেতনের ওপর নির্ভর করতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে গত মাসে। ওই মাসেও অনেক শিক্ষার্থী বেতন দেয়নি। জোড়াতালি দিয়ে কোনোমতে অন্যান্য শিক্ষকদের বেতন দিতে পেরেছি।
এ মাসে বেতন দিতে পারব কি না জানি না। কারণ স্কুল বন্ধ, ছাত্রছাত্রীরা বেতন দিচ্ছে না। কিভাবে শিক্ষকদের বেতন দেবো, আর নিজে কিভাবে চলব তা নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছি। আর বাসা ভাড়া তো মাফ নেই! দেশের এই পরিস্থিতিতে বাসা ভাড়া মওকুফের ব্যবস্থা করলে অন্তত আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষেরা কিছুটা হলেও হাফ ছেড়ে বাঁচত।
ঢাকা জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট মফিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, করোনাভাইরাস আমাদের দেশের খেটে খাওয়া ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে এনেছে। অফিস আদালত বন্ধ, ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ। শ্রমজীবী মানুষেরা এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। যারা দিন আনে দিন খায় তাদের অবস্থা আরো খারাপ। যেখানে জীবন চালানো কষ্টকর, সেখানে বাসা ভাড়া কিভাবে দেবে? সরকারের উচিত হবে, ইতালি, কানাডাসহ বিশ্বের অনন্যান্য দেশের মতো গ্যাস বিদ্যুৎ ও পানির বিল মওকুফ করা। আর এই দুর্দিনে বাড়িওয়ালাদের অন্তত তিন মাসের বাসা ভাড়া মওকুফ করার নির্দেশ প্রদান করা। এতে অন্তত নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ নিঃশ্বাস নিতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, ঢাকা সিটিতে দুই কোটি মানুষ বসবাস করে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ মানুষ বাসা ভাড়া করে বসবাস করেন। তিনি বলেন, শহরের ৫০ লাখ মানুষের অবস্থা একেবারেই নাজুক। করোনাভাইরাসের মধ্যে এই মানুষগুলো কর্মহীন হয়ে পড়ায় তারা খুবই কষ্টে জীবনযাপন করছে। সেখানে বাসা ভাড়া পরিশোধ করে জীবন চালানো তাদের জন্য দুরূহ। অনেক বাড়িওয়ালা বছরের শুরুতেই বাসা ভাড়া বৃদ্ধি করেছেন। অন্তত দেশের এই ক্রান্তিকালে বাড়িওয়ালাদের উচিত, মার্চ, এপ্রিল ও মে এই তিন মাস বাসা ভাড়া না নিয়ে মওকুফ করে দেয়া। বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, সরকারেরও উচিত, দেশের এই ক্রান্তিকালে নিম্ন আয় ও খেটে খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানো। বাসা ভাড়া মওকুফের বিষয়েও সরকার একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর এভাবে চলতে থাকলে তিন মাস পর রাজধানীতে বাসা ভাড়া করে থাকার মানুষ পাওয়া কঠিন হবে। অনেকেই ঢাকা ছেড়ে গ্রামেই বসবাস শুরু করবেন।