দেশে ক্যান্সার, কিডনি ও ডায়বেটিসে আক্রান্ত সোয়া চার কোটি মানুষ৷ করোনা ভাইরাসের আতঙ্কের কারণে তাদের অনেকেই নিয়মিত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই বিষয়ে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর অনেক বেসরকারি হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা সেবা মিলছে না বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি এমন ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন একজন স্কুল শিক্ষিকা। তিনি কিডনি, ফুসফুসে পানি জমা, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন।
ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি নিয়মিত চিকিৎসা নিতেন। কিন্তু গত বুধবার তার ভর্তি নেয়নি সেই হাসাপাতাল কর্তৃপক্ষ। এরপর আরো কয়েকটি হাসপাতালে চেষ্টা করেও তার স্বজনরা চিকিৎসা পেতে ব্যর্থ হন। সেদিন রাত ১০টার দিকে মগবাজারের রাশমনো হাসপাতালের জরুরি বিভাগে মারা যান তিনি। তার মেয়ে মাসুদা পারভীন চম্পা দাবি করেছেন, তার মায়ের করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কোন লক্ষণ ছিল না। তারপরও আতঙ্কের কারণেই হাসপাতালগুলো চিকিৎসা দেয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে ক্যান্সার, কিডনি ও ডায়বেটিসের নিয়মিত রোগীদের চিকিৎসা সেবা পাওয়া নিয়ে চিন্তিত বিশেষজ্ঞরাও৷ বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ সোসাইটি অব রেডিয়েশন অনকোলজিস্টের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. শেখ গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘‘কোন চিকিৎসক অজুহাত দেখিয়ে চিকিৎসাকর্মের বাইরে থাকতে পারেন না। কেউ যদি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকেন তাহলে তার চিকিৎসা সনদ বাতিল করা উচিৎ। করোনা ভাইরাস মুখ দিয়ে শ্বাসনালিতে প্রবেশ করে। তাই মাস্ক ব্যবহার করলেই যথেষ্ট। ডাক্তার-রোগী উভয়েই মাস্ক পরতে হবে। তারপর যদি কারো করোনা আক্রান্ত সন্দেহ হয় তাহলে তাকে আলাদা কর্নারে রেখে আইইডিসিআরকে খবর দিতে হবে। নমুনা পরীক্ষায় করোনা ধরা পড়লে আদালাভাবে তার চিকিৎসা চলবে। করোনার আগেই প্রতিদিন নানা ধরনের প্রাণঘাতি সংক্রামক ব্যাধির চিকিৎসা দিয়ে আসছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে রোগীর সেবা দেবো না, তাহলে ডাক্তার হয়েছি কেন? কোনো রোগীর সেবা না দেওয়া খুবই অন্যায়।’’
অধ্যাপক মোস্তফা বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে পাঁচ থেকে ছয় লাখ ক্যান্সারের রোগী রয়েছেন। প্রতি বছর, ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার মানুষ ক্যান্সারে মারা যান। তার মতে, ক্যান্সার প্রতিদিনই ছড়াতে থাকে, যার চিকিৎসা না হলে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।
কিডনি ফাউন্ডেশনের হিসেবে বাংলাদেশে প্রায় আড়াই কোটি থেকে তিন কোটি মানুষ কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত। প্রতি বছর ৪০ হাজার রোগীর কিডনি অকার্যকর হয়, প্রায় ৩০ হাজার মানুষ মারা যান বছরে। ডায়বেটিসে আক্রান্তদের মধ্যে ১১ ভাগ মানুষ কিডনি সমস্যায় ভুগছেন। দেশে উচ্চ রক্তচাপের রোগী আছেন তিন কোটি। এসব রোগীদেরও কিডনি সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভবনা বেশি।
ইন্টারন্যাশনাল ডায়বেটিসে ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ৮৪ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তবে দেশের ডায়বেটিক সমিতির জরিপ অনুযায়ী এই সংখ্যা দ্বিগুন। তাদের হিসাবে শতকরা ৮ ভাগ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সেই হিসেবে ১৬ কোটি মানুষের দেশে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১ কোটি ২৮ লাখে।
অধ্যাপক মোস্তফা বলেন, কিডনি, ক্যান্সার বা ডায়বেটিসে আক্রান্তদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। এ কারণে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হলে এ ধরনের রোগীদের মৃত্যু ঝুঁকি বেশি থাকে। তারা নিয়মিত চিকিৎসা না পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্রতি বছর এই সময়ে অনেকের জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা হয়৷ ক্যান্সার, ডায়াবেটিস বা কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদেরও জ্বর, সর্দি, কাশি হতে পারে। তাই বলে তাকে সেবা না দেওয়া অমানবিক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, ‘‘বেসরকারি হাসপাতালগুলোর এই ধরনের আচরণ খুবই অন্যায়। আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের বর্হিবিভাগ প্রতিদিনই খোলা রয়েছে। আমি বলব, কারো যদি খুব বেশি জরুরি হয়ে পড়ে তারা যেন আমাদের এখানে চলে আসেন। আমরা সাধ্যমত চিকিৎসা দেবো। সরকারের উচিৎ দ্রুত বেসরকারি হাসপাতালগুলো মালিকদের সঙ্গে কথা বলে সমাধান করা। যাতে রোগীরা চিকিৎসা পান।’’
তবে শুক্রবার করোনা পরিস্থিতির অনলাইন ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সংশিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে বলে শনিবার দাবি করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ।