মহাপরাক্রমশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বব্যাপী জল-স্থল অন্তরীক্ষে যার অবাধ কর্তৃত্ব। ছোট-বড় রাষ্ট্রগুলো মার্কিন মোড়লীপনা ও খবরদারিতে তটস্থ। উভয় গোলার্ধে শত্রুর প্রতিটি লক্ষ্যবস্তুতে তাক করা আছে ব্যালেস্টিক মিসাইল। শুধু নিজ ভূখণ্ড নয়; অনেক মিত্র দেশকে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ আজ নিজ দেশ অরক্ষিত। সুরক্ষা নেই জনগণের। অভ্যন্তরে চলছে মহামারী। করোনাভাইরাসে বেশুমার মরছে মানুষ। কারো জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। ভয়াবহ ঝুঁকিতে গোটা জাতির জীবন। অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির শীর্ষে অবস্থানকারী যুক্তরাষ্ট্র আজ ধরাশায়ী।
করোনাভাইরাসের সাথে যুদ্ধে পর্যুদস্ত। করোনাক্রান্ত রোগীতে সয়লাব বিশ্বের তৃতীয় জনবহুল এ দেশটি। করোনাভাইরাসের আঁতুড় ঘর চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বে মহামারীতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখন শীর্ষে। সবচেয়ে বেশি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত এখানে। মার্চের শেষ দিন পর্যন্ত এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৭৫ হাজারে। আর প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় চার হাজার মানুষ।
শুধু নিউ ইয়র্ক সিটিতেই করোনায় মৃতের সংখ্যা সহস্রাধিক। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশী-আমেরিকানদের বসবাস এ নগরীতেই। কয়েক দিনে করোনায় মারা গেছেন প্রায় ৩৫ জন বাংলাদেশী। অনেক পরিবারের সদস্য আক্রান্ত এ মহামারীতে। চার দিকে চরম আতঙ্ক। আগামী দু’সপ্তাহে অদৃশ্য এ দানব ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করবে। এমন আশঙ্কা নিউ ইয়র্ক রাজ্যের গভর্নর ও অভিজ্ঞ মহলের। এ রোগে যুক্তরাষ্ট্রে এক থেকে দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারাতে পরে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের প্রধান এবং হোয়াইট হাউজের করোনাভাইরাস টাস্কফোর্সের সদস্য ডা: অ্যান্থনি ফাউসির এমন আশঙ্কায় ঘুম হারাম হয়ে গেছে মানুষের। কে মরবে কে বাঁচবে। কোথায় পাবে নিরাপদ আশ্রয়। কে দেবে চিকিৎসার গ্যারান্টি। এসবের কোনো উত্তর মিলছে না। নির্বিঘœ ও উন্নত জীবন-জীবিকার অন্বেষায় পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা মানুষগুলো আজ বড় বেশি অসহায়। সব আশা-আকাক্সক্ষা স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে। ৩৩ কোটি আমেরিকানসহ দুনিয়ার মানুষের একটি প্রশ্নÑ যুক্তরাষ্ট্র কেন শীর্ষ করোনা আক্রান্ত দেশ হলো। বিলিয়ন ডলারের এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মনে।
সবচেয়ে ব্যয়বহুল হলেও সর্বাধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার দেশ যুক্তরাষ্ট্র। কানাডা বা ব্রিটেনের মতো কল্যাণ রাষ্ট্র নয়। তবু বিনা চিকিৎসায় এ দেশে মারা যায় না কেউ। দেশব্যাপী হাসপাতাল আছে ছয় হাজারের অধিক। শুধু ক্যালিফোর্নিয়াতে ৩৪২টি হাসপাতাল। চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। স্বাস্থ্যসেবায় সবচেয়ে বেশি মানুষ কর্মরত। নাগরিক স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের বার্ষিক ব্যয় সাড়ে তিন ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু এ পরিমাণ ১০ হাজার ৫০০ ডলার, যা মোট জিডিপির ১৮ শতাংশ। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই ব্যক্তিমালিকানাধীন এবং তাদের দ্বারা পরিচালিত। এসবের ৫৮ শতাংশ অলাভজনক। ২১ শতাংশ লাভজনক এবং মাত্র ২১ শতাংশ সরকারি। তারপরও চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ বহন করে থাকে সরকার। প্রাইভেট হেলথ ইন্স্যুরেন্স, মেডিকেড, মেডিকেয়ার, চিল্ড্রেন হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্রোগ্রাম ও ভেটারনস হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। এ ছাড়া সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশাস (সিডিসি) ফেডারেল সরকারের একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। সংক্রামক ব্যাধি ইবোলা, জিকাসহ সিডিসি বিভিন্ন ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে সম্প্রতি। এত কিছুর পরও করোনা মহামারী রুখতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। এ ব্যর্থতার দায়ভার এড়াতে পারবে না ট্রাম্প প্রশাসন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুরুতেই আমলে নেননি করোনাভাইরাসের বিষয়টি। তিনি উদ্যোগ নেননি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম করোনার রোগী শনাক্ত হয় গত ২০ জানুয়ারি ওয়াশিংটন রাজ্যের সিয়াটলের শহরতলীতে। সিডিসি ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি। ১৫ জানুয়ারি যিনি চীনের উহান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন।
আর এই উহানের হুনান শহরের একটি সি ফুড মার্কেট থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি। চীনে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ২০১৯ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি। জানুয়ারি মাসের মধ্যেই বিশ্বের ২১টি দেশে করোনায় আক্রান্ত হয় সহস্রাধিক মানুষ। এ সময়ে বারকয়েক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আছে দাবি করেন। অথচ এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস। আক্রান্ত প্রথম ৫৪ বছরের এক রোগী ১ মার্চ মারা যান সিয়াটলে। এরপরই টনক নড়ে হোয়াইট হাউজ প্রশাসনের। নড়েচড়ে বসেন সবাই। সিডিসিকে ৩ মার্চ অনুমতি দেয়া হয় করোনা টেস্টের। এ সময়ে বিভিন্ন দেশে আক্রান্ত হয় ৮৭ হাজার মানুষ। নিউ ইয়র্কে ইরানফেরত ৩৯ বছর বয়সী এক মহিলা করোনায় মারা যান ম্যানহাটনের একটি হাসপাতালে গত ১৩ মার্চ।
এরপরই যুক্তরাষ্ট্রে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন ট্রাম্প। এখন তো মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘায়িত হচ্ছে জ্যামিতিক হারে। অভিজ্ঞজন আগেই করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা এবং তা প্রতিরোধে সময়োচিত উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন সরকারকে; কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন তা গ্রাহ্য করেনি। সময়মতো করোনা টেস্টের অনুমতি প্রদান, হাসপাতাল, চিকিৎসক, নার্সসহ জনগণকে সতর্ক ও সচেতন করলে পরিণতি এমন ভয়াবহ হতো না। যা করেছে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ানসহ অনেক দেশ। করোনাভাইরাস টাস্কফোর্সে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের চেয়ে অগ্রাধিকার পেয়েছে রাজনীতিবিদরা। তা ছাড়া সবাই সে সময় ব্যস্ত ছিলেন ট্রাম্পের ইম্পিচমেন্ট, হার্ভে উইনস্টেন ও অস্কার নিয়ে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রকাশ্যে বাহাস করেছেন করোনাভাইরাসকে ‘চায়না ভাইরাস’ বলে। সর্বশেষ তিনি মারাত্মক উক্তি করেছেন ‘করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা দুই লাখে ঠেকিয়ে রাখতে পারলে তা হবে তার সরকারের সাফল্য।’ ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতাই যুক্তরাষ্ট্রকে করোনা আক্রান্তদের শীর্ষে উন্নীত করেছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে।