সুনামগঞ্জের পুরো জেলাতেই ধান কাটা শুরু হয়েছে। করোনা আতঙ্কেও বুকভরা আশা নিয়ে সোনালী ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় কাটছে কৃষকদের। সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, পাবনা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুরসহ উত্তারাঞ্চল থেকে শ্রমিক আসতে শুরু করেছেন সুনামগঞ্জে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় শ্রমিক সংকটের কারণে সময় মতো ফসল ঘরে তুলা নিয়ে উদ্বিগ্ন কৃষকরা।
বাতাসে দুলছে হাওরের ফসল। রং ছড়াচ্ছে সাথে চাষীর মনে। পাকা-অধাপাকা ধানের মৌ-মৌ গন্ধে ভরে গেছে হাওর। তবে আংশিক ধানে চিটা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। দেশি জাত ধানের সাথে বিআর-২৮ জাতের ধানও কাটা শুরু হয়েছে। জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, দিরাই-শাল্লা ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জসহ পুরো জেলায় ধান ঘরে তোলার আমেজ।
জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৫৪টি হাওরে ২ লাখ ২৪ হাজার ৭১৯ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ ৩২ হাজার ৭৯২ মেট্রিক টন। টাকার অঙ্কে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। বছরে একটি মাত্র বোরো ফসলকে ঘিরেই হাওরাঞ্চলের মানুষের যত স্বপ্ন। বহু প্রত্যাশীত সোনালী ধান ঘরে তুলতে করোনা আতংকের মাঝে কৃষাণ কৃষাণীরা ব্যস্ত ধানের কাজে। অবহাওয়া ভালো থাকলে আর সপ্তাহ খানেকের মধ্যে পুরোদমে ধান কাটা শুরুর হবে।
এসময় সবার ঘরে-ঘরে থাকবে ধান আর ধান। হাজারো স্বপ্নে বিভোর কৃষকরা এখন রাত যাপন করছেন ধান কাটার অধীর আগ্রহে। কিন্তু শত স্বপ্নের মাঝেও মনে আতঙ্কের কমতি নেই। মেঘলা আকাশ বা বৃষ্টি হলেই তাদের চেহারাটা হয় ফ্যাকাসে। মেঘের হুঙ্কার যেন তাদের অন্তরে আঘাত করে। পাহাড়ি ঢল তাদের মনে ভাবনা জাগায় বার-বার। চৈত্রের প্রচন্ড অভাবে দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে চরম দুর্দিন কাটিয়েছেন কৃষকরা। তাই ধান ক্ষেতে তাকালে মনের অজান্তেই একটু হলেও তৃপ্তি ফুটে উঠে তাদের মুখে। মনের গভীর থেকে মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন ভালোয় ভালোয় ফসল ঘরে তুলার প্রত্যয়ে। বেশ কয়েক বছর ধরে ফসল হারানো নিঃস্ব কৃষকরা এবার কষ্টে ফলানো ধান গোলায় ওঠানোর স্বপ্ন দেখছেন।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, পাউবোর সংশ্লিষ্টরা হাওরে কৃষকের ধান কাটার সাথে সংহতি প্রকাশ করেছেন। তারা কৃষক ও শ্রমিককে হাওরে নেমে পাকা ধান কাটতে আহ্বান জানিয়েছেন। ধান কাটায় নামলে শ্রমিকদের ত্রাণ দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন। সুনামগঞ্জের হাওরের প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ধান কাটতে আসে বিশাল শ্রমিক বাহিনী। কৃষকের বাড়িতে এক মাস থেকে ধান কেটে মোটা অংকের পারিশ্রমিক নিয়ে বাড়ি ফিরে। ভালোভাসে ধান কাটা শেষে বাড়ি ফেরার সময় শ্রমিকদের গরু-খাসী ও নতুন পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী উপহার দেয় কৃষকরা। যেন এক মাসে একটা মায়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে কৃষক-শ্রমিকে। এখন আর আগের মতো শ্রমিক না আসায় ধান কাটার জন্য শ্রমিক সংকটে পড়তে হয় কৃষকদের।
পাকনা হাওরের কৃষক রফিক মিয়া বলেন, এবার বহু কষ্টে দেনা করে ফসল করছি। আল্লার রহমতে ভালো ফলন হইছে। ধান কাটা শুরু করছি। কৃষক তোফায়েল আলম চৌধুরী ছানা মিয়া বলেন, সারা বছর কষ্ট করে দেনা করে ফসল ফলাইছি। ফলনও ভালো হইছে। আগুল্লিয়ায় চিটাতে ক্ষতি হইছে। কয়েক দিনের মধ্যেই আমার ধান কাটা শুরু হইব। তবে করোনার ভয়ে ধান কাটার শ্রমিক পাচ্ছিনা।
কৃষক প্রবাল মিয়া বলেন, আল্লায় যদি কয়েকটা দিন রোদ দেয় তাইলে হাওরের ফসল ঘরে যাইবো। হালির হাওরের কৃষক আব্দুর রহিম বিআর-২৮ জাতের ধান কেটেছেন, ফলনও হয়েছে ভালো, আর সপ্তাহ খানেক পর হালির হাওরে পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, সারা জেলায় হাইব্রীড, উফশি ও স্থানীয় জাতের বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। সদর উপজেলায় ১৬ হাজার ১৫০ হেক্টর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় ২২ হাজার ৪৭৫ হেক্টর, দোয়ারাবাজার উপজেলায় ১৩ হাজার ১০০ হেক্টর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় ১১ হাজার ৪৯০ হেক্টর, জগন্নাথপুর উপজেলায় ২০ হাজার ৭২৫ হেক্টর, জামালগঞ্জ উপজেলায় ২৪ হাজার ৬৬০ হেক্টর, তাহিরপুর উপজেলায় ১৮ হাজার ৩০০ হেক্টর, ধর্মপাশা উপজেলায় ৩১ হাজার ৮০০ হেক্টর, ছাতক উপজেলায় ১৪ হাজার ৮০০ হেক্টর, দিরাই উপজেলায় ২৮ হাজার ৯৩০ হেক্টর ও শাল্লা উপজেলায় ২২ হাজার ১০ হেক্টর, মোট ২ লাখ ২৪ হাজার ৪৪০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সফর উদ্দিন বলেন, হাওরের ধান কাটতে শ্রমিক ও কৃষককে প্রতিদিনই উৎসাহিত করছি। ধান কাটতে মাইকিং করা হচ্ছে। ত্রাণের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে ধান কাটার শ্রমিকদের। তাছাড়া বাইরের জেলা থেকে অন্তত ২ হাজার শ্রমিক জেলায় প্রবেশ করেছে। কিছু এলাকায় ধান কাটার মেশিনের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এ সংকট সরকারের একার পক্ষ্যে মেটানো সম্ভব নয়। এজন্য এলাকার ধনী কৃষকদের এগিয়ে আসতে হবে। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি ভালো মানের ধান কাটার মেশিন কিনতে পারেন। এতে তারা নিজেরা যেমন উপকৃত হবে পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি কৃষকরাও উপকৃত হবেন।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, করোনা ভাইরাস আমাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ছন্দপতন ঘটিয়েছে। জীবন পরিচালনা আরো কঠিন হয়েছে। হাওরে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু শ্রমিক সংকট কৃষকদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এই অবস্থায় কৃষকদের সাহস ও শ্রমিকদের উৎসাহ দিতে হাওরে নেমে সংহতি প্রকাশ করেছি। হাওরের ধান তুলতে পারলে আমাদের কোনো অভাব থাকবে না।