‘প্রিয় প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, দয়া করে ব্রিটেনে এনএইচএসের সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষার জিনিসপত্র নিশ্চিত করুন। মনে রাখবেন, আমরা হয়তো ডাক্তার/নার্স/স্বাস্থ্য সেবা কর্মী, যাদের প্রতিদিন সরাসরি রোগীদের সংস্পর্শে আসতে হয়, কিন্তু আমরাও মানুষ, আমাদেরও মানবাধিকার আছে। আমাদেরও অধিকার আছে এই পৃথিবীতে সন্তান এবং পরিবার পরিজন নিয়ে রোগমুক্তভাবে বেঁচে থাকার।’
ফেসবুকে এই খোলা চিঠির লেখক ব্রিটিশ-বাংলাদেশী চিকিৎসক ডাঃ আবদুল মাবুদ চৌধুরী। ফেসবুকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে এই পোস্টটি দিয়েছিলেন ১৮ই মার্চ। এর কয়েকদিন পর তিনি এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী দুজনেই আক্রান্ত হন কোভিড-নাইনটিনে। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় তাদের দুজনকেই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নিয়ে যেতে হয়।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে অবস্থার উন্নতি হওয়ায় বৃহস্পতিবার হাসপাতালের আইসিইউ হতে সাধারণ ওয়ার্ডে নিয়ে আসা হয়েছে। আর তাকে করোনাভাইরাসের বিপদ সম্পর্কে যিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, সেই ডাঃ আবদুল মাবুদ চৌধুরী বুধবার রাতে করোনাভাইরাসে মারা গেছেন।
ডাঃ চৌধুরীর এই ট্র্যাজিক মৃত্যুর খবরটি বৃহস্পতিবার থেকেই ব্রিটিশ গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম দখল করে আছে। করোনাভাইরাসের কারণে সামনের কাতারে থাকা ডাক্তার/নার্স/স্বাস্থ্য কর্মীরা যে কত বিরাট ঝুঁকির মধ্যে আছে, সেই প্রশ্ন আবারও উঠছে।
ব্রিটেনে করোনাভাইরাসের শিকার প্রথম বাংলাদেশী ডাক্তার
ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বা এনএইচএস-এ কাজ করেন শত শত বাংলাদেশি ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মী। ডাঃ আবদুল মাবুদ চৌধুরী হচ্ছেন এদেশে করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া প্রথম বাংলাদেশি ডাক্তার। তিনি ছিলেন ইউরোলজির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তার স্ত্রীও একজন ডাক্তার। তারা দুজনেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। তার স্ত্রী সেরে উঠলেও ডাঃ আবদুল মাবুদ চৌধুরীর অবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটে। তাকে মৃত্যুর আগের কয়েকজন হাসপাতালের আইসিইউ’তে ভেন্টিলেটার রাখতে হয়েছিল।
লন্ডনে এনএইচএসে কর্মরত আরেকজন বাংলাদেশি ডাক্তার বিশ্বজিৎ রায় মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগেও ডাঃ চৌধুরীকে দেখতে গিয়েছিলেন। পারিবারিক বন্ধু হিসেবে তিনি ডাঃ চৌধুরীকে চেনেন বহু বছর ধরে। ডাঃ বিশ্বজিৎ রায় বলছিলেন, সপ্তাহখানেক আগে ডা. চৌধুরীর জ্বর এবং ডায়রিয়া দেখা দেয়।
‘করোনাভাইরাস হলে যেসব উপসর্গ থাকার কথা সেগুলোর কোনটিই তার মধ্যে দেখা যায়নি। যখন তার মধ্যে যখন সামান্য ডেলিরিয়ামের (প্রলাপ) লক্ষণ দেখা দেয় তখন তিনি নিজেই হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হন।’
হাসপাতালে যাওয়ার পর জানা যায় যে- ডাক্তার আবদুল মাবুদ চৌধুরীর ফুসফুসটি ভালভাবে কাজ করছে না।
‘প্রথম দিন থেকেই তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তিন দিন পর তাকে হাসপাতালে ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে সরিয়ে নেয়া হয়।’
কৃত্রিম অক্সিজেন দিয়েও যখন ডা. চৌধুরীর অবস্থার কোন উন্নতি হলো না, তখন তাকে ভেন্টিলেশনে দেয়া হয়।
ডাক্তার বিশ্বজিৎ রায় বলছিলেন, ভেন্টিলেশন দেয়ার পর প্রথমদিকে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়।
‘কিন্তু এরপর তার গায়ে আবার জ্বর দেখা দেয়। একইসাথে তার কিডনি, লিভার ইত্যাদির কাজ বন্ধ হয়ে যায়, যাকে আমরা ‘মাল্টি অর্গান ফেইলিউর’ বলে থাকি।’
বুধবার হাসপাতাল থেকে জরুরী বার্তা এলো ডাঃ চৌধুরীর পরিবারের কাছে। ডাঃ বিশ্বজিৎ রায় তাদের সঙ্গে ছুটলেন হাসপাতালে।
‘আমরা বুঝতে পারছিলাম পরিস্থিতি সংকটজনক। আমরা তখনো আশা ছাড়িনি। আমরা আশা করছিলাম অলৌকিক কিছু ঘটবে, ও আমাদের মাঝে ফিরে আসবে।’
বুধবার রাত সাড়ে দশটায় ডাঃ চৌধুরী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
করোনাভাইরাস মহামারির বিরুদ্ধে ব্রিটেনে প্রথম কাতারে থেকে লড়াই করছেন যেসব ডাক্তার, এপর্যন্ত তাদের মধ্যে অন্তত নয় জন নিজেরাই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। আর এই ডাক্তারদের সবাই অভিবাসী অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান, মিশর, নাইজেরিয়া, সুদানসহ বিভিন্ন দেশে এদের জন্ম। এই তালিকায় এখন সর্বশেষ যুক্ত হলো বাংলাদেশী ডাক্তার আবদুল মাবুদ চৌধুরীর নাম।
শোকাহত বাংলাদেশী কমিউনিটি
ডাঃ আবদুল মাবুদ চৌধুরী ছিলেন ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে সুপরিচিত মুখ। যুক্ত ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। তিনি পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশের সিলেট ক্যাডেট কলেজ এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে। স্ত্রী, এক ছেলে এবং এক মেয়েকে নিয়ে ছিল তার সংসার।
তার ছেলে ইনতিসার চৌধুরী স্কাই নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন,‘ভুল ধরিয়ে দিতে আমার বাবা কোনদিন ভয় পাননি। কারণ তিনি তার সহকর্মী, বন্ধু, পরিবার- সবার কথা ভাবতেন। এমনকি যাদের সঙ্গে হয়তো তার দেখা হয়নি, তাদের কথাও তিনি ভাবতেন।’
ইনতিসার এবং এবং তার ১১-বছর বয়সী বোন ওয়ারিশা তাদের বাবার এই ট্র্যাজিক মৃত্যুর সত্ত্বেও চিকিৎসক হওয়ারই স্বপ্ন দেখছে। তারা সেই পেশাতেই যেতে চায়, যে পেশায় কাজ করতে গিয়ে তাদের বাবা মারা গেলেন। সূত্র : বিবিসি