করোনার কারণে চলতি অর্থবছরে (২০১৯-২০২০) দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ২ থেকে ৩ শতাংশ হতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে বিশ্বব্যাংক। শুধু তাই নয়, এর পরের অর্থবছরে (২০২০-২০২১) প্রবৃদ্ধি আরো কমে হবে ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। তারপরের অর্থবছরে (২০২১-২০২২) এই প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ২ দশমিক ৮ থেকে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে।
রোববার সকালে ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ক’দিন আগেও অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এবারো দেশের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ঘরে থাকবে।
বিশ্বব্যাংক তাদের সর্বশেষ এ এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, করোনা মহামারী উৎপাদন খাতসহ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে তৈরী পোশাকসহ উৎপাদিত পণ্যের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাহিদা বেকারত্বের ঝুঁকি তৈরি করবে এবং দারিদ্র্য বাড়াবে। নগরের দরিদ্ররা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, গ্রামীণ এলাকায়ও দরিদ্রের সংখ্যা বাড়বে। দেশজুড়ে সবকিছু বন্ধ থাকায় (লকডাউন) ব্যক্তিপর্যায়ে ভোগ কমে যাবে। মধ্যমেয়াদে প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারের আশা থাকলেও বিশেষ করে দেশে কোভিড-১৯-এর বিস্তার ও আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা থেকে নিম্নমুখী ঝুঁকি বিরাজমান থাকবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার কারণে যে লকডাউন চলছে তাতে করে এ বছর দক্ষিণ এশিয়ার যে প্রবৃদ্ধি হবে তা গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশের অবস্থা আরো খারাপ হবে। দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশে প্রবৃদ্ধি তো হবেই না বরং ঋণাত্মক থাকবে। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির দিক থেকে ভালো অবস্থানে থাকবে ভারত। অবশ্য তার পরের অর্থবছরে ভারতেরও ধস নামবে প্রবৃদ্ধি অর্জনে।
চলতি অর্থবছরসহ আগামী তিন অর্থবছরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াবে আফগানিস্তান, তারপরে মালদ্বীপ। এ ছাড়া বাকি দেশগুলো তিন অর্থবছরে ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। মূলত ৭ এপ্রিল পর্যন্ত নেয়া দেশগুলোর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে এ পূর্বাভাষ দেয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ও ভুটানে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন বলেন, এই মহামারীর প্রভাব নির্ভর করছে কত দ্রুত এর বিস্তার ঘটছে এবং কত দ্রুত করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে, তার ওপর। করোনা প্রাদুর্ভাবের সাথে সাথে বাংলাদেশ সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় নির্দেশনা আর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ মাসের শুরুতে করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশকে ১০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এই মহামারীকে নিয়ন্ত্রণে আনা এবং দ্রুত পুনরুদ্ধারের সহায়তা দেয়ার বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এ বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্টিং শেফার বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সরকারগুলোর অগ্রাধিকার দেয়া উচিত করোনা বিস্তার রোধ করা এবং নিজ দেশের জনগণ বিশেষ করে অতিদরিদ্র যারা নিরবচ্ছিন্নভাবে দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মুখোমুখি হয়- তাদেরকে রক্ষা করা। কোভিড-১৯ এ অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য এই মহামারীর পর কী ধরনের নতুন নীতিমালা গ্রহণ করছে তার ব্যাপারে একটি জরুরি বার্তাই দিচ্ছে তারা । এই নীতি ব্যর্থতার পরিণতি হবে দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং দারিদ্র্য বিমোচনের যে কষ্টসাধ্য ধারা চলছে তার বিপরীতমুখী প্রবণতায় চলে যাওয়া।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় চলে যাবে মালদ্বীপ, তারপর যথাক্রমে আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান। এই দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে যাবে।
ঋণাত্মক না হলেও চলতি অর্থবছরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বেশি ক্ষতি হবে যথাক্রমে নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও ভারতের। অর্থাৎ, এই দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে চলতি অর্থবছরে থাকছে ভারতই।
চলতি অর্থবছরে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার দিকে চলে যাওয়া মালদ্বীপের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে ৫ শতাংশ থেকে কমে ঋণাত্মক ১৩ শতাংশ থেকে ঋণাত্মক ৮ দশমিক ৫ শতাংশে। তবে এরপরের অর্থবছরই দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াবে মালদ্বীপ। ২০২১ সালের অর্থবছরে দেশটির প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৬ দশমিক ৩ থেকে ৭ দশমিক ৩ শতাংশে। ২০২২ অর্থবছরে দেশটির প্রবৃদ্ধি আবার কিছু কমে ৫ থেকে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে আসতে পারে।
চলতি অর্থবছরে খারাপের দিকে দ্বিতীয় স্থানে থাকা আফগানিস্তানের এবারের প্রবৃদ্ধি হবে ঋণাত্মক ৫ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে ঋণাত্মক ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। তার পরের বছর প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। ২০২২ সালের অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি আরো বেড়ে ৫ দশমিক ২ থেকে ৬ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে।
খারাপের দিক থেকে তৃতীয় স্থানে থাকা শ্রীলঙ্কার প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরে ঋণাত্মক ৩ থেকে ঋণাত্মক দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। তার পরের অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি সামান্য বেড়ে দশমিক ২ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে। তার পরের বছর সামান্য বেড়ে ২ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে।
নেপালের প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরে ১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে বলে উল্লেখ করছে বিশ্বব্যাংক। তবে পরের অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। ২০২২ সালের অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে। আর ভুটানের প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরে ২ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। ২০২১ সালের অর্থবছরে ২ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে। আর ২০২২ সালের অর্থবছরে ৩ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।
বাংলাদেশের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য হচ্ছে, দেশটির প্রবৃদ্ধি গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। তবে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ২ থেকে ৩ শতাংশ। পরবর্তী অর্থবছরে (২০২০-২১) প্রবৃদ্ধির পরিমাণ আরো কমতে পারে। এ সময় ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসতে পারে প্রবৃদ্ধি। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে অল্প বেড়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ২ দশমিক ৮ থেকে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে চলতি অর্থবছরে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা ভারতের প্রবৃদ্ধি এবার ৪ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ হতে পারে। তার পরের অর্থবছরে প্রবৃদ্ধিতে ধস নামতে পারে। ২০২১ সালের অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমে ১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসতে পারে। আর ২০২২ সালের অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ হতে পারে।