করোনা নামটি বর্তমানে সারা বিশ্বে এক আতঙ্কের নাম। অদৃশ্য নীরব ঘাতক ভাইরাসটি এরই মধ্যে সারা পৃথিবীতে কেড়ে নিয়েছে লক্ষাধিক প্রাণ এবং আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১৮ লাখ মানুষ। এর মাঝে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ লাখের বেশি এবং মৃতের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি অর্থাৎ আমেরিকা এখন মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন। মারা গেছেন শতাধিক প্রবাসী বাংলাদেশী। শুধু নিউ ইয়র্ক সিটিতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৮০ হাজার এবং মৃতের সংখ্যা সাড়ে সাত হাজার। নিউ ইয়র্ককে বলা হচ্ছে আমেরিকায় করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কেন্দ্রস্থল। নিউ ইয়র্ক সিটির কুইন্স বরোতে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বাধিক এবং এই সিটিতে ভাইরাসের কেন্দ্রস্থল হলো কুইন্স বরোতে অবস্থিত ‘করোনা’ নামক এলাকা। আমি বর্তমানে সেই করোনা সিটিতে সপরিবারে অবস্থান করছি এবং এখানে বসেই এই লেখাটি লিখছি। আমার বাসস্থানের তিন মাইলের মাঝে রয়েছে চাইনিজ অধ্যুষিত ফ্লাশিং সিটি এবং এলমার্স্ট হাসপাতাল যেটি নিউ ইয়র্ক সিটির হাসপাতালগুলোর মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা প্রদান করছে। সদা কর্মচঞ্চল নিউ ইয়র্ক সিটিতে যেন নেমে এসেছে মৃত্যুপুরীর নীরবতা। আমার বাড়ির পেছনে লংআইল্যান্ড এক্সপ্রেসওয়ে হাইওয়ে থেকে দিন-রাত কেবল শোনা যায় বিষাদের সাইরেন বাজিয়ে ছুটে চলা অ্যাম্বুলেন্সের অসহনীয় শব্দ।
প্রশ্ন জাগতে পারে আমেরিকার মত এত উন্নত দেশে করোনাভাইরাস মহামারীর আকার ধারন করল কিভাবে? তার উত্তরে সেই বাংলা প্রবাদটিই যথার্থ বলে মনে করছি আর সেটা হলো ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’। বর্তমান বিপর্যয়ে এ দেশের জনগণ ট্রাম্প প্রশাসনের বিলম্বিত পদক্ষেপকেই মূলত দায়ী করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান প্রদেশে কিছু মানুষের রহস্যজনক অসুস্থতার বিষয়ে আগাম সতর্কতামূলক বার্তা জারি করে। পরে ১১ জানুয়ারি চীন প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে। ২১ জানুয়ারি প্রথম আমেরিকার ৩০ বছরের এক যুবক যিনি চীনের উহান প্রদেশ ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে আসেন তার শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাস ধরা পড়ে। ২৯ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে আমেরিকার প্রথম কোনো করোনা আক্রান্ত রোগী মারা যায়। তখন পর্যন্ত ট্রাম্প প্রশাসন কোভিড-১৯-কে বেশ হালকাভাবেই নিয়েছিলেন। অবশেষে ১৭ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর সন্ধান মিলে অর্থাৎ পুরো আমেরিকায় ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। এই অযাচিত বিলম্বিত পদক্ষেপ মানুষের জীবনযাত্রা, প্রাণ ও অর্থনীতির ভয়ানক ক্ষতিসাধন করেছে বলে অনেকেই বিশ্বাস করছেন। এ বিষয়ে ওবামা প্রশাসনের সাবেক হেলথ ও হিউম্যান সেক্রেটারি ক্যাথেলিন সেবেলিয়াস বলেন, ‘আমরা মূলত মূল্যবান দুই মাস সময় অপচয় করেছি।’ নিউ ইয়র্কের স্বনামধন্য ওপধযহ ঝপযড়ড়ষ ড়ভ গবফরপরহব ধঃ গড়ঁহঃ ঝরহধর-এর গবেষকরা তাদের সাম্প্রতিক গবেষণা কর্মে চূড়ান্তভাবে মোট ৭৮ জন আক্রান্ত রোগীর ওপর গবেষণা করে দেখেন যে তাদের মধ্যে কেবল একজন এশিয়া থেকে এই ভাইরাসটি নিউ ইয়র্কে বহন করে নিয়ে আসে এবং বাকি সবাই ইউরোপ থেকে আক্রান্ত হয়ে নিউ ইয়র্কে আসেন। ওই সিটিতে এই ভাইরাসের আগমন শুরু হয় ফেব্রুয়ারির প্রথমভাগে। অর্থাৎ সময়োচিত পদক্ষেপ নিয়ে যদি ইউরোপের সাথে ভ্রমণ যোগাযোগ বন্ধ করা হতো কিংবা আগে থেকে পরীক্ষার ব্যবস্থা শুরু করা হতো, তবে যুক্তরাষ্ট্রকে হয়তো এমন মহাবিপর্যয়ে পড়তে হতো না।
আমাদের দেশে বৃহৎ হতদরিদ্র কর্মজীবী গোষ্ঠী রয়েছেন যারা দিন আনে দিন খায় অবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করেন। তাদের জীবিকা ও আয় উপার্জনের জন্য বাধ্য হয়েই ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে। তাদের ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কিছু পদক্ষেপের খবর শুনে আশান্বিত হওয়ার পাশাপাশি কিছুটা হতাশাও গ্রাস করছে। যখন দেখি সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কতিপয় দলীয় অসাধু ব্যক্তি দুর্নীতি ও অনাচারের পথ বেছে নিয়েছেন। সরকারকে এ বিষয়ে আরো কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে এই দুর্যোগ তাদের জন্য একটি সুযোগ এনে দিয়েছে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের। তারা যদি এই আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয় তবে ইতিহাসের কাছে তাদের দায়বদ্ধতা রয়ে যাবে। পাশাপাশি সমাজের অবস্থাশালী ধনবান ব্যক্তিদেরও অনুরোধ করব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশে সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে। এ ক্ষেত্রে অনেক প্রবাসী ভাইবোনেরাও ব্যক্তিগত ও সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে জানা যায়।
অতীতেও মানবগোষ্ঠী এ ধরনের মহাদুর্যোগ ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে বহুবার এবং সৃষ্টিকর্তার মহানুভবতায় নিজেদের সুচিন্তিত গবেষণা, প্রচেষ্টা, ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে সেই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠেছে। আমরা আশা করছি বর্তমান দুর্যোগ ও মহামারীও আমরা কাটিয়ে উঠব ইনশা আল্লাহ। তবে এই দুর্যোগের পাশাপাশি আমরা সম্ভবত মুখোমুখি হতে যাচ্ছি অর্থনৈতিক ও খাদ্য মহামন্দায়। এ ধরনের মহামন্দা মোকাবেলার ক্ষেত্রে দু’টি চমৎকার উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের সময় নিরবচ্ছিন্ন খাদ্য সরবরাহ বজায় রাখা এবং জনগণের মনোবল চাঙ্গা রাখার লক্ষ্যে উন্নত অনেক দেশের সরকার তাদের জনগণকে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বাড়ির আঙিনায় ফলমূল, শাকসবজি উৎপাদনে উৎসাহিত করে আশাতীত ফলাফল পায়। সেই উদ্যোগের নাম দেয়া হয় ‘ওয়ার গার্ডেন’ বা ‘ভিক্টোরি গার্ডেন’। বর্তমানে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধের পাশপাশি ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক ও খাদ্য সঙ্কটকে সফলভাবে মোকাবেলার জন্য আগাম সমন্বিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করা যেতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে কোভিড-১৯ মহামারী পুরো বিশ্বকে একটি কঠিন যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এতে জয়ের জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত সচেতনতা, সতর্কতাসহ সবার সম্মিলিত প্রয়াস। পরিশেষে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব এই মহামারী ও দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পাক, মানুষের জীবনে স্বাভাবিকতা ফিরে আসুকÑ আমেরিকায় ‘করোনা সিটি’ থেকে এই প্রার্থনা করছি। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের সহায় হন। আমিন।