করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। আগের চেয়ে বেড়েছে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন। করোনা আক্রান্তদের মধ্যে রোগ লুকিয়ে রাখার প্রবণতা থাকায় চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী। সরকারিভাবে চিকিৎসক আক্রান্তের কোনো তথ্য দেয়া না হলেও চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে দেশব্যাপী পাঁচ শতাধিক চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। তবে বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন (বিডিএফ) বলছে, তাদের কাছে দুই শতাধিক চিকিৎসক আক্রান্তের তথ্য আছে। ইতোমধ্যে অনেক চিকিৎসক-নার্স আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশনে আছেন। আবার প্রথমে না জানলেও পরে জেনে সেল্ফ কোয়ারেন্টিনে আছেন অনেক চিকিৎসক। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে একসময় করোনাভাইরাস তো বটেই এমনকি অন্যান্য সাধারণ রোগের চিকিৎসা দেয়ার জন্য চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী পাওয়া যাবে না। গত ১৫ এপ্রিল করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা: মো: মঈন উদ্দিন মৃত্যুবরণ করেছেন এসব কারণে।
শুধু যে রোগীদের পক্ষ থেকে তথ্য গোপনের শিকার হচ্ছেন চিকিৎসকরা তা নয়; কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের কারণে রোগীরাও জানতে পারছেন না তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
সরকারিভাবে সরাসরি কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন (বিডিএফ) গতকাল মঙ্গলবার বলেছে, গতকাল পর্যন্ত দেশব্যাপী সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের দুই শতাধিক চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। বিডিএফের ডা: নিরুপম দাস বলেছেন, বাংলাদেশে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন মূলত মানহীন পিপিই’র কারণে। এ ছাড়া রোগীদের ভাইরাসের লক্ষণ গোপন করা থেকেও চিকিৎসকরা আক্রান্ত হচ্ছেন। চিকিৎসক ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে দেড় শতাধিক নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন অত্যন্ত বিপজ্জনক এই ভাইরাসে।
গতকাল মঙ্গলবার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, এ হাসপাতালের কমপক্ষে ২৫ জন করোনাভাইরাসে পজিটিভ। গতকাল সকাল পর্যন্ত বলা হয়েছে, সলিমুল্লাহর ৪০ জন চিকিৎসক আক্রান্ত; কিন্তু পরে বিকেলে পিসিআর পরীক্ষায় এদের অনেকেই নেগেটিভ হয়েছেন। পরে সংখ্যাটি চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী মিলে ২৫ জনের কথা বলা হচ্ছে।
গতকাল দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক আয়েশা আক্তার জানিয়েছেন, কতজন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে আমরা তা সংগ্রহের চেষ্টা করছি।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন দ্রুত ছড়িয়ে পড়া, রোগীর তথ্য গোপন, অপরিকল্পিত বহির্বিভাগ, নিম্নমানের পিপিই এবং সার্বিক অব্যবস্থাপনায় চিকিৎসকদের মধ্যে করোনাভাইরাসে সংক্রমণের হার বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা: মোজাহেরুল হক বলেন, আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। এতে স্বাস্থ্য খাত ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, দেশের স্বার্থে চিকিৎসকদের প্রতি মনোযোগ দেয়া উচিত সরকারের । তাদের সুরক্ষার উত্তম ব্যবস্থা করতে না পারলে পুরো চিকিৎসাব্যবস্থাই ভেঙে পড়তে পারে।
একজন চিকিৎসক অথবা স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত হলে তাদের ১৪ দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকতেই হবে। অধিকতর নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো ১৪ দিন থাকতে হয় সাবধানে। এভাবে চিকিৎসকরা আক্রান্ত হলে অথবা কোয়ারেন্টিনে চলে গেলে একসময় করোনা ছাড়া অন্যান্য চিকিৎসাসেবা দেয়ার মতো কোনো চিকিৎসক অথবা স্বাস্থ্যকর্মী পাওয়া যাবে না। অধ্যাপক মোজাহেরুল হক এ ব্যাপারে সরকারের আশু দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
জানা গেছে, এর আগে চিকিৎসাধীন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হওয়ায় বন্ধ হয় রাজধানীর ডেল্টা ও আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের কার্যক্রম। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হলে বন্ধ হয় ইনসাফ বারাকাহ কিডনি হাসপাতালের কার্যক্রম। ইমপালস হাসপাতালের গাইনি বিভাগের চার চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় ওই বিভাগের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তথ্য গোপন করে করোনা আক্রান্ত এক রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন ইব্রাহিক কার্ডিয়াক হাসপাতালে। প্রথমে স্বীকার না করলেও পরে চিকিৎসকদের কাছে সত্য কথা জানায় রোগীর স্বজনরা। এরপরই বন্ধ করে দেয়া হয় হাসপাতালের সিসিইউ, কোয়ারেন্টিনে নেয়া হয় ২০ জন চিকিৎসককে।
না জেনে চিকিৎসা নিতে এসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাঁচ বিভাগের বেশ কয়েকটি ইউনিটের সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনে থাকা প্রায় অর্ধশতাধিক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর করোনা পরীক্ষা করা হয়। সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৯ জন চিকিৎসক, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চারজন ইন্টার্ন চিকিৎসকসহ ছয়জন, কুর্মিটোলা, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপক এবং গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক আক্রান্ত হয়েছেন রোগীরা তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নিতে আসায়।