সরকারঘোষিত প্রণোদনার প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৫০ হাজার কোটি টাকাই ব্যাংক খাতের জোগান দেয়ার কথা ছিল। এতে ব্যাংকগুলোর সুদের ওপর সরকার সাড়ে ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু ব্যাংকগুলোর তহবিল সঙ্কটের কারণে এ প্রণোদনার অর্থ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিতরণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। এমনি পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর টাকার সঙ্কট মেটাতে ৫০ হাজার কোটি টাকার অর্ধেক অর্থাৎ ২৫ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুনঃঅর্থায়ন তহবিল আকারে জোগান দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
গতকাল বৃহৎ ঋণ ও সার্ভিস সেক্টরের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা টাকা প্রণোদনার অর্ধেক তহবিল জোগান দেয়ার জন্য ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী রোববার ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনার ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা জোগান দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর দীর্ঘ দিন ধরেই টাকার সঙ্কট চলছে। করোনাভাইরাসের কারণে দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি দেয়ার আগে থেকেই কোনো কোনো ব্যাংকের এ তহবিল সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করে। প্রতিদিনই ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ধার করে চলছিল। এ জন্য গড়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে জোগান দিয়ে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু সাধারণ ছুটির পরে ব্যাংক লেনদেন সীমিত হয়ে পড়ে। এ সময়ে ব্যাংক লেনদেনকারীদের বেশির ভাগই আপৎকালীন সময়ের প্রয়োজন মেটাতে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করেছে। এখনো সে প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর তহবিল সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করে। সারা দেশে সীমিত ব্যাংক লেনদেন করার জন্য শাখা খোলা রাখার নির্দেশনা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেয়া হলেও বেশির ভাগ ব্যাংকই মোট শাখার ২০ ভাগও খোলা রাখছে না। ২০০ শাখার মধ্যে মাত্র ২০টি শাখা খোলা রেখেছে কোনো কোনো ব্যাংক। পালাক্রমে শাখাগুলো বন্ধ রাখায় গ্রাহক হয়রানি বাড়লেও ব্যাংকগুলো অনেকটা নিরুপায় হয়ে পড়ে।
এর মধ্যে করোনাভাইরাসের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য সরকার প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ৫০ হাজার কোটি টাকাই ব্যাংকগুলোর জোগান দেয়ার কথা ছিল। ৫০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকা বৃহৎ ঋণ এবং ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ দেয়ার নীতিমালা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ৩০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে উদ্যোক্তারা তিন বছরের জন্য ঋণ নিতে পারবেন। এ জন্য উদ্যোক্তাদের ব্যাংকের সুদ দিতে হবে সাড়ে ৪ শতাংশ, আর বাকি সাড়ে চার শতাংশ সুদ ভর্তুকি হিসেবে ব্যাংককে পরিশোধ করবে সরকার। অপর দিকে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণের সুদের মধ্যে উদ্যোক্তারা ৪ শতাংশ সুদ পরিশোধ করবে। বাকি ৫ শতাংশ সুদ ভর্তুকি হিসেবে ব্যাংককে পরিশোধ করবে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, সীমিত ব্যাংক লেনদেনের মধ্যে ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহক শুধু অর্থ উত্তোলন করছেন, কেউ অর্থ জমা দিচ্ছেন না। ব্যবসায়ী কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ায় এতে ব্যাংকের নগদ লেনদেন কমে গেছে। এমনি পরিস্থিতিতে সরকারঘোষিত প্রণোদনার অর্থ ছাড় করার ক্ষেত্রে এক রকম অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। প্রণোদনার অর্থ সুবিধাভোগীদের কাছে পৌঁছাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তাই অর্ধেক তহবিল জোগান দেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এ সিদ্ধান্তের আলোকে গতকাল ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার অর্ধেক অর্থাৎ ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলোর জোগান দেয়ার জন্য ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল আকারে ব্যাংকগুলোর জোগান দেয়া হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুনঃঅর্থায়ন নীতিমালা জারি করা হয়েছে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, আগে যেখানে প্রণোদনার শতভাগ অর্থ ব্যাংকগুলো দেয়ার কথা ছিল, এখন তার ৫০ ভাগ দিতে হবে। তবে, প্রথমে ঋণ বিতরণ করার পর পরের মাসের ১০ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর হিসাবে ৫০ শতাংশ অর্থ জমা দেবে। এ তহবিলের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে তিন বছর। প্রতি ত্রৈমাসিক অর্থাৎ তিন মাস পর পর বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিলের কিস্তি আকারে ফেরত দিতে হবে। কোনো ব্যাংক ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ কেটে নেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, একইভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য যে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার অর্থ ঘোষণা করা হয়েছিল ওই প্রণোদনারও অর্ধেক অর্থাৎ ১০ হাজার কোটি টাকা জোগান দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে আগামী রোববার ব্যাংকগুলোর জন্য নীতিমালা ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সূত্র জানায়, মূলত ব্যাংকগুলোর তহবিল সঙ্কটের মধ্যে প্রণোদনার অর্থ সুবিধাভোগীদের মধ্যে পৌঁছানোর জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রসঙ্গত, গত ১২ এপ্রিল ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার অর্থ বিতরণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালা জারি করেছিল। ওই নীতিমালায় বলা হয়েছিল ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব অর্থায়নে বৃহৎ ও সার্ভিস সেক্টরের চলতি মূলধন জোগান দেয়ার জন্য ঋণ বিতরণ করবে। এ ঋণ দিয়ে কোনো বকেয়া ঋণ পরিশোধ করা যাবে না। এমনকি কোনো ঋণখেলাপিও এ প্রণোদনার কোনো সুবিধা পাবেন না। একই সাথে কোনো ঋণ তিনবারের বেশি নবায়ন হলে ওই ঋণগ্রহীতাকেও এ ঋণের অর্থ বিতরণ করা যাবে না।