চিকিৎসক আদিব হাসান জটিল এক রোগের কারণে ২০১০ সালের পর থেকে শরীরে ব্যথা ছাড়া জীবন কেমন তা ভুলে গেছেন।ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তাঁর পেটে চামড়ার নিচে ব্যথানাশক একটি পাম্প বসিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু তাতেও ব্যথা থেকে নিস্তার পাননি। দুই পায়ে অনুভূতি নেই বললেই চলে। তবে দুই পায়ের ভেতরে তীব্র ব্যথা।হুইল চেয়ারে বসেই কেটে যাচ্ছে জীবন। তবে আদিব হাসানকে এই জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত করাতে সার্বক্ষণিক ছায়ার মতো লেগে আছেন তাঁর স্ত্রী চিকিৎসক নাফিসা আক্তার। ফলাফল হলো, যে মানুষটার বেঁচে থাকাটাই কঠিন ছিল, সেই আদিব এখন শুধু নিজের জীবনের সঙ্গেই অভ্যস্ত হয়েছেন তা নয়, চেম্বারে বসে রোগীদের ব্যথা নিরাময়ের চিকিৎসাও করছেন। রাজধানীর উত্তরার ল্যাবএইডে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আদিবের ভাষায়- শুধু স্ত্রী পাশে আছে বলেই এসব সম্ভব হয়েছে।
স্ত্রী নাফিসার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশেই সম্প্রতি তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি লেখা পোস্ট করেন। যা ফেসবুকে ভাইরাল হয়। আদিবের মতে, স্ত্রী হলে স্বামীর সেবা করবেই, তাতে আবার কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে কেন এ ধারণায় তিনি বিশ্বাসী নন। নাফিসা তাঁর জন্য যা করছেন তার জন্য অবশ্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে।
আদিব নাফিসার বিয়ে হয় ২০১০ সালের জুলাই মাসে। আর বছরটির ডিসেম্বর মাস থেকেই আদিবের শারীরিক নানান জটিলতার শুরু।সেই অর্থে এই দম্পতি অন্যদের মতো সংসার বলতে যা বোঝায় তা করার সুযোগ পাননি। তাঁদের স্বপ্নগুলোকে নতুন করে সাজাতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
স্ত্রী নাফিসা ইন্টার্নাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। চিকিৎসক আদিবের বাবা এম এ হাসান এবং মা যাকিয়া মাহফুজা যাকারিয়াও চিকিৎসক। আদিবের এক বোন এবং এক ভাই দেশের বাইরে থাকেন। তাঁরা চিকিৎসা পেশায় আসেন নি। রাজধানীর উত্তরায় নিজ বাসায় এই চিকিৎসক পরিবার গড়ে তুলেছেন কিওর ইউর পেইন সেন্টার। যাঁর যাঁর নিজেদের চেম্বারের বাইরে তাঁরা এখানে সময় দিচ্ছেন। আদিব নিয়মিত রোগী দেখছেন। ব্যথা মানুষকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যায় তা তিনি ভালো ভাবেই অনুভব করতে পারেন।২০১০ সালের ডিসেম্বরে শরীরে মেনিনজাইটিস ও এনকেফালাইটিস এর উপস্থিতি টের পান আদিব। ২০১১ সালের শুরুর দিকে দুর্বলতা দেখা দেয়। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে সিরিংগোমাইয়েলিয়া রোগটি ধরা পড়ার পর ২০১৩ সালের মধ্যে তিনটি অস্ত্রোপচার করতে হয়। ২০১৫ সালে করতে হলো চতুর্থ অস্ত্রোপচার। চিকিৎসার জন্য চীন, জার্মানি, ভারতে যেতে হয়েছে কয়েকবার। শুরু হয় ভারতের এক পুনর্বাসন কেন্দ্রে জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রশিক্ষণ ।
সম্প্রতি উত্তরার বাসায় আদিব যখন হিসাব করে তাঁর অসুস্থতার কথা বলছিলেন পাশে বসে তা শুনছিলেন স্ত্রী এবং আদিবের বাবা-মা। তাঁদের চেহারাই বলে দিচ্ছিল তাঁরা কোন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন পার করেছেন। আর আদিবের বাবা-মা’ও স্বীকার করলেন, আদিবের এ পর্যন্ত আসা এবং যুদ্ধে সফল হতে সব থেকে বেশি অবদান নাফিসার। জানিয়ে দিলেন, নাফিসা এখন আর এ পরিবারের বউ নয়, তাঁকে তাঁরা নিজের মেয়ের মতোই মনে করেন।
আদিব বলছিলেন,‘ ২০১০ সালের পর সুস্থতার কাছাকাছিও কখনো যেতে পারিনি। আগের সুস্থ জীবনের কথা মনেও করতে চাই না। আর আমার যে অবস্থা এর মধ্য দিয়েই জীবন পার করতে হবে। শরীরের অবস্থা আস্তে আস্তে আরও খারাপ হবে। তবে শুরু থেকে স্ত্রী নাফিসা সব হাসিমুখে মেনে নিয়েছে। দীর্ঘদিন পায়ে হাত না বুলিয়ে দিলে ঘুমাতে পারতাম না, স্ত্রী সারা রাত পায়ের কাছে বসে হাত বুলিয়ে দিত। সেখানেই ঘুমিয়ে যেত। রক্তশূন্যতা দেখা দিলে স্ত্রী রক্ত দেয় আমাকে। ও ওর বাবার বাড়ি যায়নি বহু বছর।এমন ও হয়েছে, পাশে বসে থেকে একটু অন্যদিকে তাকালেও আমি রেগে যেতাম, বলতাম অন্যদিকে তাকাচ্ছ কেন? নির্ভরশীলতার কারণেই এটা হয়েছে। এখনো আমি সারা রাত একটানা ঘুমাতে পারি না, আমি জেগে গেলেই স্ত্রীর ঘুম ভেঙে যায়। এক দিক থেকে আরেক দিকে ফিরিয়ে দিতে হয়।আমার মনে হয়, আমার জায়গায় আমার স্ত্রীর এ ধরনের অসুখ হলে আমি ও যেভাবে করছে আমি সেভাবে সেবা করতে পারতাম না।’আদিব বলেন, অসুস্থতার পর দুই বছর ঘরে বন্দী থাকতে হয়েছে। বিছানা থেকে নামতে পারতেন না। পেটের ভেতরে যে বিশেষ পাম্প বসানো তার ব্যবস্থাপনা বাসাতেই করছেন স্ত্রী এবং বাবা-মা। হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়াসহ নানান জটিলতা দেখা দিচ্ছে। এখন মাসেই প্রায় ৫০ হাজার টাকার ওষুধ লাগছে। শুধু আদিবের কারণে বাবা-মাকে বাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে। আত্মীয়-বন্ধুরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
আদিবের বাবা-মা এবং আদিব ও তাঁর স্ত্রী ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। বাবা-মা এক সময় নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন, আদিবের বেলাতেও তাই ঘটেছে। সবকিছু ভালোভাবেই চলছিল, আদিবের অসুস্থতা পরিবারটিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তবে পরিবারটির সদস্যরা মনের জোরে এবং বন্ধু, আত্মীয়সহ সবার সহায়তায় পরিস্থিতিকে হাসিমুখেই বরণ করে নিয়েছেন।
আদিবের অসুস্থতার পর থেকে নাফিসার পুরো জগৎটাই পাল্টে গেছে। নিজের বাবার বাড়িতে গিয়েও সেভাবে থাকতে পারেন না। কেননা, আদিবের কোন সময় কোনটা প্রয়োজন তা নাফিসা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবেন না।
হাসিমুখে এই দায়িত্ব পালন করতে রাগ লাগে কি না জানতে চাইলে নাফিসা হাসি মুখেই বললেন,‘আদিব ব্যথায় যে পরিমাণ কষ্ট পান তা দেখে শুধু আমি কেন পরিবারের কেউ তখন আর রাগ করতে পারেন না।অসুস্থতার মধ্যেও স্ত্রী নাফিসার কারণে আদিব কখনোই পড়াশোনায় ইস্তফা দিতে পারেননি। নাফিসাও নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন শত ব্যস্ততার মধ্যে। আদিব ২০১৬ সালের নভেম্বরে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেন। স্বামী স্ত্রী দুজনেই এমআরসিপি (মেডিসিন) ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। এফসিপিএস প্রশিক্ষণের শেষ প্রান্তে আছেন আছেন তাঁরা। ভবিষ্যতে যুক্তরাজ্যসহ উন্নত কোনো দেশে গিয়ে চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালনের ইচ্ছে আছে তাঁদের। তাঁরা মনে করছেন, এতে তাঁদের দুটো লাভ হবে। প্রথমত আদিবের জন্য চিকিৎসাটা সহজ হবে। আর উন্নত দেশে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যে কোনো প্রতিবন্ধকতা না, হুইল চেয়ারে বসলেই যে জীবন শেষ হয়ে যাওয়া না তা নিয়ে অনেক বেশি জানার সুযোগ হবে । তাঁরা দেশে ফিরে এ নিয়ে ভালোভাবে সচেতনতামূলক কাজ করতে পারবেন।
নাফিসাকে ভালো একটি চাকরি ছাড়তে হয়েছে। বর্তমানে তিনি উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নাফিসা সম্পর্কে আদিবের মা যাকিয়া বলেন, ‘আমার ছেলের সঙ্গে নাফিসার যখন বন্ধুত্ব ছিল তখন দেখেছি তাদের রোমান্টিকতার চেয়েও সম্পর্কটা ছিল বন্ধুত্ব এবং মানসিক নির্ভরশীলতার যা এখনো অটুট আছে। ওদের গভীর সম্পর্ক। নাফিসার ভেতরে কি হচ্ছে তা বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবে না। ওর কারণেই ছেলের এত বড় বিপর্যয়ে আমরা ভেঙে পড়িনি। মনে সাহস পেয়েছি।’
আর নাফিসাকে নিয়ে আদিবের বাবা এম এ হাসান বলেন,‘ আমরা জানি, ছেলের শরীর আস্তে আস্তে অবশ হয়ে যাবে। ছেলে চিকিৎসক, সেও তা ভালোভাবেই জানে। ছেলের কষ্ট আমরা বুঝতে পারি না বা বুঝতে দিতে চায় না। ওর জগৎটা একদমই আলাদা। এই ভিন্ন জগতে কেউ যদি বিচরণ করতে পারে সে হলো নাফিসা। ’
আদিব পিয়ানোতে বসে যখন সুর তুলছিলেন তখন নাফিসা আদিবের আদিবের ঘাড়ে হাত রেখে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দুজনের মুখের হাসিই বলে দিচ্ছিল, হয়তো সারা জীবনই একজন আরেক জনের পাশে থাকবেন।