মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সবার প্রিয় বাহারি রঙের পাঞ্জাবির সাথে টুপি। তার আগে পুরো রমজান মাসে মুসলমানরা কমবেশি সবাই মসজিদে নামাজ পড়েন, তাই বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসে টুপি বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়াও সামনেই আসছে ঈদ, পাঞ্জাবীর পাশাপাশী অবশ্যই টুপি চাই। আর এই সুযোগে টুপি দোকানদারদের পাশাপাশি গ্রাম্যবধূরা এর সাথে জড়িত। প্রতিবছর এ সময় টুপি তৈরিতে চরম ব্যস্ত সময় পার করেন তারা।
গ্রাম্যবধূদের তৈরি এই সব টুপি দেশের বাজরে চাহিদা মিটিয়ে সৌদি আরব, দুবাই, কাতার, পাকিস্থান, ভারত সহ বেশ কয়েকটি দেশে সুনাম কুড়িয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে রফতানি হতো হাতে তৈরি এই জালি টুপি। আর এই সকল টুপি তৈরির সাথে জড়িত পাঁচ লাখ নারী শ্রমিক এবং প্রায় দুই শ’ ব্যাপারী। গ্রামের বধুরা ঘরের কাজ শেষ করে অবসর সময়ে নানা সুখ-দুঃখের আলাপচারিতা আর জমানো গল্পের আসরেই চলে তাদের রকমারি হাতের কাজ। তাদেরই নিপূণ হাতের ছোঁয়া আর সুতা ও ক্রুশ কাটা এই দু’য়ের মিলিত বন্ধনেই তৈরি হচ্ছে রঙ-বে-রঙয়ের রকমারি টুপি। এগুলো দেশের সীমানা পেরিয়ে আজ সূদুর সৌদি আরব, পাকিস্তান, দুবাই, কাতার, ভারতসহ সব মুসলিম দেশেই প্রায় রপতানি হত, যা থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা বৈদেশিক অর্থ আয় হত। সেই সাথে ওদের ভাগ্যের সাথে দেশীয় অর্থনীতির চাকাও বেশ জোরোসোরেই ঘুরতো। কিন্তু এ বছর করোনার কারণে বিদেশে পাঠাতে না পেরে গোডাউনে আটকে পরে আছে এই সব টুপি। বিক্রি করতে পারছে না গ্রামের কারিগর। মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা।
জানা যায়, বগুড়ার শেরপুরের চকধলী, জয়লা-জুয়ান, জয়লা-আলাদি, কল্যাণী, চক-কল্যাণী ও গুয়াগাছী এবং ধুনটের বোহালগাছা, চৌকিবাড়ি, ফড়িংহাটা, কুড়হা-হাটা, বিশ্বহরিগাছা, চাঁনদার, ভূবনগাতি, চালাপাড়া, পাঁচথুপি, থেউকান্দি ও বাটিকাবাড়ি সহ এই দুই উপজেলায় ছয় শ’ পরিবার এই টুপি শিল্পের সাথে জড়িত।
ব্যাপারী রাজু আকন্দ জানান, পাঁচ লাখ নারী এ পেশার সাথে জড়িত রয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারো ঈদকে সামনে রেখে এ পেশায় আরো কয়েক হাজার নারী-পুরুষের আগমন ঘটেছে। কিন্ত করোনার প্রাদুর্ভাবে এ সব টুপি বিদেশে রফতানি না হওয়ায় আমরা বেকার হয়ে পড়েছি। আমাদের অর্থ আটকে পড়েছে, মানবেতর জীবন যাপন করছি।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, প্রায় ২০ বছর আগে ওইসব গ্রামে টুপি বুনোনের কাজ শুরু হয়। বোহালগাছা গ্রামের বৃষ্টি খাতুন, মর্জিনা বিবি, হ্যাপি, রানা, শিরিন আকতার জানান, তারা জন্মের পর থেকেই নিজেকে টুপি বানানোর পেশার সাথে যুক্ত করেছেন। তাদের মতে, বাড়িতে কর্মহীন হয়ে বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা করাই ভাল। এমন ভাবনা এবং বংশীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করতেই অনেকেই টুপি তৈরির শিল্পের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন।
বিথি, সাবিনা ইয়াসমিন, সুর্বনা ও শিউলি জানান, তারা স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি টুপি তৈরি করে থাকেন। এছাড়া গ্রামের গৃহবধূরা সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে টুপি বানিয়ে থাকেন। তা থেকে আয়ও মন্দ হয় না। বিশেষ করে রমজানে গ্রামে গ্রামে টুপি তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। সবকিছু বাদ দিয়ে গৃহবধূরা টুপি তৈরির কাজ করেন। এ সময় বাড়ির অন্যান্যরাও বাদ থাকেন না। তারা কোনো না কোনোভাবে ওই কাজে সহযোগিতা করেন।
তারা জানান, বিভিন্ন এলাকার ব্যাপারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সূতো দিয়ে আসেন। পরে সূতার দাম কেটে রেখে অবশিষ্ট টাকা দিয়ে টুপি কেনেন।
ব্যাপারী মোঃ আব্দুল মান্নান জানান, ঠিকমত কাজ করলে দিনে ৩/৪টি টুপি বুনোনো সম্ভব। ৭০ টাকা দামের এক ববিন সূতা দিয়ে ১২টি টুপি তৈরি করা যায়। যা ৪০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। ব্যাপারীরা বাড়িতে গিয়ে সূতার ববিন দিয়ে আসেন এবং টুপি তৈরি শেষ হলে নিজেরাই খরিদ করে থাকেন। ওইসব রকমারি টুপি তারা সৌদি আরব, পাকিস্তান, দুবাই, কাতার, ভারত সহ মুসলিম দেশগুলো পর্যায়ক্রমে বিক্রি করে।
বাংলাদেশ জালি টুপি অ্যাসোসিয়েশনের বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফিরোজ উদ্দিন সোহাগ জানান, সরকার যেমন গারমেন্স শিল্পকে রফতানিতে যে ভর্তুকি প্রদান করে তেমনইভাবে এই শিল্পকে টিকে রাখতে হলে সরকার এই জালি টুপিতে ভুর্তিকি দিতে হবে।
অ্যাসেসিয়েশনের বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি জুয়েল আকন্দ বলেন, প্রতি বছর প্রায় আমরা ৫০ কোটি টাকার অধিক বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনি। কিন্ত করোনার কারণে এ বছর রমজানে কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা লোকসান হয়েছে। এর সাথে এই শিল্পের সাথে জড়িত পাঁচ লক্ষাধিক নারী এবং দুই শ’ ব্যাপারী লোকসান গুনছেন এবং মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আমরা সরকার থেকে কোনো অনুদান বা কোনো সহযোগিতাও পাইনি। এই শিল্পকে টিকে রাখতে হলে এই দুর্দিনে সরকারকে পাশে দাঁড়াতে হবে। নইলে এই শিল্প ধ্বংস হবে। কোটি কোটি টাকা প্রতি বছর রাজস্ব খাত হতে বঞ্চিত হবে।