ভারতের রাজধানী দিল্লিতে তাবলীগ জামাতের সদর দফতরে হাজার হাজার লোকের সমাবেশ থেকে অসংখ্য মানুষের ভেতর করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা দেখা দেয়ার পর গোটা বিষয়টি নিয়ে তীব্র সাম্প্রদায়িক বিতর্ক শুরু হয়েছে। অথচ দিল্লিতে তাবলীগ জামাতের মূল সমাবেশটি হয়ে ছিলো ভারতে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ হওয়ার একদিন আগে।
ইতিমধ্যেই ওই সমাবেশে যোগ দেয়া প্রায় দেড়শতাধিক ব্যক্তি করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। সারা ভারতে করোনাভাইরাসে এখনও পর্যন্ত যে অন্তত ৩৮টি মৃত্যু হয়েছে, তার মধ্যে অন্তত দশটির সাথে ওই তাবলীগ জামাত সমাবেশের সম্পর্ক পাওয়া গেছে।
কিন্তু দেশে মহামারি আইন চালু থাকাকালীন এভাবে এক জায়গায় হাজার হাজার লোক এনে সমাবেশের আয়োজন করে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের একটি বিশেষ সেক্ট (তাবলীগ) বিরাট অপরাধ করেছে, ভারতে অনেকেই বিষয়টিকে সেভাবে তুলে ধরতে চাইছেন।
তবে মঙ্গলবার জম্মু ও কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও সদ্য বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাওয়া ওমর আবদুল্লা টুইট করেছিলেন, ‘তাবলীগের এই ঘটনায় একদল লোক মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর সুযোগ পেয়ে যাবেন।’
‘#তাবলীগী ভাইরাস হ্যাশট্যাগ দিযে যারা টুইট করছেন, তারা আসলে প্রকৃতির সৃষ্টি করা যে কোনো ভাইরাসের চেয়েও বেশি ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখেন’, আরো লিখেছেন ওমর আবদুল্লা।
মিডিয়াতে মুসলিম-বিরোধী প্রচারণার রেশ ধরে আইনজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট প্রশান্ত ভূষণও আক্ষেপ করেছেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত এই ভাইরাসের কোনো চিকিৎসাও নেই, কোনো টিকাও নেই!’
এই গোটা ঘটনায় ইসলামের একটি ধর্মীয় সেক্টের (তাবলীগ) দায় যতটা, দিল্লি পুলিশ বা প্রশাসনের ব্যর্থতাও যে ততটাই, সেটাও আবার অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
‘রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে এবং দিল্লি পুলিশের নাকের ডগায় সব নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাবলীগ এত দিন ধরে এত বড় জমায়েত করল, আর প্রশাসন কিছু জানতেই পারল না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?’, ফেসবুকে লিখেছেন অ্যাক্টিভিস্ট রজত ট্যান্ডন।
দিল্লি পুলিশের নিজামুদ্দিন থানা যে তাবলীগের ওই মসজিদের একেবারে গা ঘেঁষে, সেটাও তিনি মনে করিয়ে দিযেছেন।
‘মহামারি গুলি মারো’
সাংবাদিক রানা আইয়ুব টুইট করেছেন, ‘যখন ভাবা হচ্ছিল লকডাউন এই দেশটাকে আরও বেশি দয়ালু আর সহানুভূতিশীল করে তুলবে, তখনই দেখা যাচ্ছে মানুষের সাম্প্রদায়িক চেহারা আরও বেশি করে ফুটে বেরোচ্ছে!’
‘মহামারি গুলি মারো, তার আগে মুসলিমদের তো ভিলেন বানানো যাক’, তাবলীগের ঘটনার প্রসঙ্গে আরও লিখেছেন তিনি।
তাবলীগ আত্মপক্ষ সমর্থনে যে বিবৃতি দিয়েছে, সেটির সূত্র ধরে রানা আইয়ুব আরও মনে করিয়ে দিয়েছেন সরকার আচমকা লকডাউন ঘোষণা করায় ট্রেন-বাস-প্লেন সব বন্ধ হয়ে যাওয়াতেই জমায়েতে আসা দেশি-বিদেশি লোকজন আটকা পড়ে গিয়েছিলেন।
ফলে এখানে তাবলীগকে শুধু একতরফা দোষ দিলেই চলবে না, যুক্তি দিচ্ছেন তিনি।
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক সাকেত গোখলে আবার টুইট করেছেন গত ১৬ মার্চ দিল্লির কালকাজি মন্দির থেকে রিপোর্ট করা একটি টিভি চ্যানেলের ভিডিও ফুটেজ, যেখানে দেখা যাচ্ছে শত শত মানুষ মন্দিরে ভিড় করে পুজো দিতে এসেছেন।
এর চার দিন আগেই দিল্লি সরকার শহরে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছিল। তাবলীগ জামাতের মূল সমাবেশটিও হয়ে গিয়েছিল তার একদিন আগেই।
ওই ভিডিও টুইট করে সাকেত গোখলে এটাই বলতে চেয়েছেন, সামাজিক দূরত্ব মানার শর্ত ভেঙে ধর্মীয় উপাসনালয়ে সমবেত হওয়ার জন্য একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে দায়ী করা ঠিক হবে না, এই ‘অপরাধে’ হিন্দু ও মুসলিম উভয়েই অপরাধী।
তবে তাবলীগের ওই সভা নিয়ে মিডিয়া চ্যানেলগুলো কিংবা কোনো কোনো রাজনীতিবিদ ও অ্যাক্টিভিস্ট সাম্প্রদায়িক বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেও দিল্লির পুলিশ ও প্রশাসন দাবি করছে, তারা বিষয়টিকে একেবারেই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে না।
দিল্লির নিজামুদ্দিন থানায় অফিসার-ই-চার্জের সাথে তাবলীগ জামাত কর্তৃপক্ষের সাত-আটজন সিনিয়র সদস্যের একটি বৈঠকের ভিডিও রেকর্ডিং সোষ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করে অনেকেই বলছেন, পুলিশ অন্তত বিষয়টিকে ধর্ম দিয়ে বিচার করছে না।
বিজেপি-পন্থী বলে পরিচিত বলিউড পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীও ওই ভিডিও পোস্ট করে টুইট করেছেন, ‘আমাদের পুলিশ যে সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীনভাবে ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে, এটা দেখে আমি গর্বিত।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব লাভ আগরওয়াল, যিনি রোজ ভারতের করোনাভাইরাস পরিস্থিতির আপডেট জানিয়ে ব্রিফিং করছেন, তিনিও তাবলীগের এই ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘যা হয়েছে তা হয়ে গেছে। এই ঘটনার ইমপ্যাক্ট কীভাবে এখন কমানো সম্ভব আমরা সেটাই দেখছি – কার কী দোষ ছিল সেটা এই মুহুর্তে না-দেখলেও চলবে।’
সূত্র : বিবিসি