মোহনার জল ছুঁয়ে ট্রলার ভিড়লো দ্বীপচর শামছুদ্দিনে। পূর্ব উপকূলের জেলা লক্ষ্মীপুরের দ্বীপ রমণীমোহনের কমলনগরের চর-কালকিনির অংশ এই চর। এখানে বাস করে ২৫টি পরিবার।
চরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা খালের পাড় ধরে হাঁটছি। লক্ষ্য করলাম, দূরে একজন বসে কাজ করছেন। এগিয়ে গিয়ে নাম জানতে চাইলাম। উত্তর পেলাম- ‘মো. হোসেন।’
‘কী করছেন?’
‘বাগদা বাইছতেছি। গাঙের তন ধরি আইনছি। অন বাইছতেছি। বেইচতে নিমু ওই পারে।’ আঙুল দিয়ে কোনটা বাগদা, কোনটা চিংড়ি চিনিয়েও দিলেন- ‘এই যে এইটা বাগদা, ভিতরে কালো দাগ দেইখলে বুইঝবেন এইটা হইল বাগদা।’
মো. হোসেনের বয়স ২৬। কথা হচ্ছিল তার ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে। ঝড়-তুফান তো দূরের কথা সামান্য বাতাসেও ঘর কেঁপে ওঠে। জোয়ারের পানিতে এলাকার সব তলিয়ে যায়। তখন চারপাশে পানি আর পানি! অথচ পানি খাওয়ার উপায় নেই। ‘এই যে হানি খাই, এগুলা কি কলের হানি? গাঙের তন আনি। ফিটকারী দিয়া পরিষ্কার কইরা খাই। ইয়ানে কুনো হানির কল নাই।’ বললেন মো. হোসেন।
ঘরের ভেতর রান্না করছিলেন হোসেনের স্ত্রী নাসরিন আক্তার। সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া নবজাতকের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি সংসার সামলাচ্ছেন। অভিযোগের সুরে নাসরিন বললেন, ‘আইজ ৫-৬ বছর লাগাত ইয়ানে থাই। সমিস্যা অয় বেশি জোয়ার আইলে আর তুফান উঠলে। অনেক সুম দ্যাহা যায়, ভাতে পোকামাকড়, পিঁপড়া ঢুকি পড়ে। পরিষ্কার করি তারপর ভাত খাইতে অয়।’
অদূরে হানিফ মিয়ার ঘর। ৬৫ বছর বয়সি এই পৌঢ় কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমাদের কথা শুনে বসার টুল এগিয়ে দিলেন। তার মুখেই শুনলাম চর শামছুদ্দিনের গল্প। দশ বছর হলো চরে বসতি হয়েছে। কোনো জমি-জমা নাই। গরু-ছাগল বর্গা পেলে সেই অর্থে চলে সংসার। মাছ ধরেও উপার্জন হয় টুকটাক। চরে চোর-ডাকাতের উপদ্রব নেই। শান্তি বলতে এটুকুই। কিন্তু বড় সমস্যা গাছপালা নাই। ঝড়-তুফান এলে আতঙ্কে দিন কাটে। জানা গেল, মহিষের কারণে এই চরে গাছ হয় না। হানিফ মিয়া ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘গতকাইলও আমার কলাগাছের চারা মহিষে নষ্ট করি দিছে!’
এতো কষ্ট করে এখানে থাকেন কেন? প্রশ্নের উত্তর যেন ঠোঁটেই ছিল। ‘এইখানে আমরা যারা থাহি, কেউ গাঙে ভাঙা, কারো জায়গাজমি নাই। চরের জমিগুলা ওপারের লোকজনের।’ বলেন হানিফ মিয়া।
চরে মসজিদ নাই, মক্তব নাই, একটা স্কুলও নাই। ‘পোলাপাইনগুলারে যে একটু পড়ামু, সেইটাও পারি না। ওই পারে জাগো কেউ থাকে, তারা দু’একটারে পড়ায়। শুক্কর বারে জুমার নামাজ পইড়তে গাঙ পার অই ওই পাড়ে যাওন লাগে।’ হানিফ মিয়ার অভিযোগ শেষ হয় না।
এমন অভিযোগ এই চরের প্রত্যেকের। এমনকি ১০ বছরের শিশু সোনিয়াও বলল, ‘কই পড়মু? স্কুল তো নাই আঙ্গো।’ স্কুলে ভর্তি করে দিলে পড়বে? জানতে চাইতেই সোনিয়ার ঝটপট উত্তর, ‘অবশ্যই পড়মু। কিন্তু হেই সুযোগই তো নাই!’
সোনিয়ার মা লাইলী বেগম। চিংড়ি রেণু বাছাই করতে করতে বললেন অসুবিধার কথা, ‘এই যে দ্যাখেন- কি অবস্থায় থাকি আমরা! কয়দিন আগেও ঝড়-তুফান অইলো। জোয়ারে সব ভাইসা গেল। তখন অই তিনতলা ঘরে (আশ্রয় কেন্দ্র) ছিলাম। আমাগো আল্লাহ ছাড়া কেউ নাই।’
দ্বীপের বয়স্কা নারী আলেয়া বেগমের কণ্ঠেও আক্ষেপ ঝরে পড়ে- ‘কেও নাই আমাগো। ৬ কেজি চাইল, ডাইল আর কিছু সদাই পাইছিলাম- এই শ্যাষ! আমাগো নাম লিখা নেয় বারবার আইসা, কিছুই তো পাই না।’