বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলাটি যমুনা নদী বেষ্টিত। এ অঞ্চলের বসবাসকারী পুরুষের পাশাপাশি নারীরা বরাবরই কর্মপ্রেমী ও সংগ্রামী হয়ে থাকেন। চরাঞ্চলের এ মানুষগুলো অভাবের মধ্যে বড় হওয়ায় জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকতে হয়ে ওঠেন ভীষণ পরিশ্রমী।
বগুড়া সারিয়াকান্দি উপজেলার চরাঞ্চলের বিভন্ন বাঁধ ও স্থানীয় চাতালগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, এ অঞ্চলের পরিশ্রমী নারীদের কর্মব্যস্ততা। চোখে পড়ে, সংসারের অভাব দূর করতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের সমানতালে কাজ করার দৃশ্য।
সরেজমিনে দেখা যায়, শুষ্ক মৌসুম শেষের এ সময়টায় মানুষের নানা কর্মব্যস্ততা থাকে। বর্ষাকে সামনে রেখে স্থানীয় চাতাল ও যমুনার বাঁধে নেড়ে দেওয়া মরিচ শুকানো এবং বাছাইয়ের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন চরাঞ্চলের সংগ্রামী নারীরা। ভালো ও মন্দ মরিচগুলো আলাদা করা ও রোদে শুকানোর কাজে ব্যস্ত দেখা যায় তাদের। বাজারে ভালো মরিচের দাম বরাবরই বেশি হয়ে থাকে এবং মন্দগুলোর একটু কম। আর তাই ভালো-মন্দ মরিচ বাছাইয়ের কাজগুলো নিখুঁতভাবে করতে নারীরাই উপযুক্ত।
এ অঞ্চলে শুকনো মরিচ সংক্রান্ত কাজটি সাধারণত নারীদের দিয়েই করানো হয়। পুরুষরা এ কাজ করলেও নারীদের মতো নিখুঁত হয় না। ক্ষেত থেকে মরিচ ওঠানোর কাজটাও পুরুষের পাশাপাশি নারীদের সিংহভাগ অংশই করে থাকেন। একইভাবে মরিচ শুকানো ও বাছাইয়ের কাজটিও নারীরাই করে থাকেন।
বছরের শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি কমে যায় এবং তখন যমুনার বিশাল বুকজুড়ে শোভা পায় মাইলের পর মাইল চর। চরের এসব জমিতে নদী ভাঙনের শিকার মানুষগুলো তাদের সামর্থ অনুযায়ী মরিচ, ভুট্টা, কাউন, বাদামসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্য উৎপাদন করে থাকেন। এর মধ্যে মরিচ অন্যতম।
চরাঞ্চলে উৎপাদিত সেই মরিচ নিয়েই মৌসুমের শেষ সময়ে যমুনা বেষ্টিত এলাকাগুলোতে চলছে নারীদের কর্মযজ্ঞতা। এভাবেই অঞ্চলের নারী-পুরুষ মিলে অভাবে গোচানোর সংগ্রামে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে নারীরা মজুরি পেয়ে থাকেন পুরুষের তুলনায় অর্ধেক।
শাহিনুর, বিলকিস, জমেলা, সাহিদা, সালাম, হাবিবসহ বেশ কিছু শ্রমিক জানান, শুষ্ক মৌসুম শেষের দিকে। বর্ষা আসন্ন। প্রতিবার বর্ষায় যমুনা হিংস্রতার রূপ নেয়। বসতভিটা কেড়ে নেয়, আশ্রয় নিততে হয় বাঁধে। যাওয়ার কোনো জায়গা না থাকায় যমুনাকেই বুকে আঁকড়ে বেঁচে থাকেন তারা।
তারা জানান, চরে উৎপাদিত মরিচসহ রকমারি ফলস চরাঞ্চলের মানুষগুলোর হারানো শক্তি অনেকটাই ফিরিয়ে দেয়। যেহেতু বর্ষা মৌসুম চলে আসছে আর তাই কৃষকের উৎপাদিত পণ্যগুলো খুর শিগগিরই ঘরে তুলতে হবে। এজন্য তারা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
দেলোয়ারা বেগম জানান, বছরের শুষ্ক মৌসুমের অপেক্ষায় থাকেন তারা। সংসারের অভাব দূর করতে যমুনার পানি নেমে গেলে জেগে ওঠা চরে কৃষি কাজে যোগ দেন তারা। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন। অভাব ঘোচাতে পুরুষের পাশাপাশি পরিশ্রম করেন পুরুষের সমতুল্যই। কিন্তু দিন শেষে শ্রমের মজুরি পান ২০০-২৫০ টাকা।
তিনি জানান, সামনে বর্ষা আসছে। বর্ষাকালের সময়টায় কোনো কাজ থাকবে না। আতঙ্কে আর অলস সময় কাটাতে হবে তাদের। এ সময়টায় সংসারে অভাব তারা দেয়। তবে, বর্ষার পরবর্তীতে আবারও তারা যমুনার বুকে কৃষি কাজে নেমে পরবেন। সংসারের প্রয়োজনে শ্রম বিক্রি করে অর্থ আয় করবেন।
তিনি আরও জানান, চরাঞ্চলের জমিতে ফসল ফলানোর আসল কাজটি পুরুষরাই করে থাকেন। এরমধ্যে সেচ ও জমি প্রস্তুতির বিষয়টি অন্যতম। এছাড়া কীটনাশক ও স্প্রে করার কাজও রয়েছে। সেই কাজগুলো তাদের স্বামীরা বা পুরুষরাই করে থাকেন বলে যোগ করেন তিনি।
আফিল উদ্দিন জানান, অব্যাহত যমুনার ভাঙনে অসংখ্য পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। অভাব-অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করেই টিকে আছেন চরাঞ্চলের মানুষগুলো। তবে প্রত্যেক বছরের শুষ্ক মৌসুমের সময়টাতে আগ্রাসী যমুনা তার বিশাল বুক উজার করে এসব অভাবী মানুষের ফসল উপহার দেয়।
এনায়েত মিয়া জানান, যমুনা চরে ভুট্টা, কাউন, বাদামের চাষ হয়ে থাকে। তবে এ জেলার চরাঞ্চলের মরিচের খ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে। তাই চরের বেশির ভাগ মানুষই মরিচ চাষ করে সংসারের বাড়তি আয়ের চেষ্টা ও অভাবী সংসারের অভাব কিছুটা দূর করার চেষ্টা করেন।
তারা জানান, উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ও চরাঞ্চলে চাষ হওয়া মরিচ শুকানো ও বাছাইয়ের কাজ সাধারণত নারীরাই করে থাকে।
বগুড়া জেলার চরাঞ্চলের তিনটি উপজেলার মধ্যে সারয়াকান্দির মানুষগুলো তাদের সংসার জীবনে সংগ্রাম করেই বেঁচে থাকেন। বর্ষায় ঘর-বাড়ি হারা হয়ে আর নদী ভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটে তাদের। জীবনধারণে পুরুষের পাশাপাশি এ অঞ্চলের নারীরা সংসারের হাল ধরেন। পরিশ্রম করেন পুরুষের সমতুল্যই। তবুও শ্রমের সঠিক পারিশ্রমিক জোটে না তাদের।