বিশ্বজুড়ে তরুণ প্রজন্মের কাছে ডিপ্রেশন একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। যে সমস্যাগুলো কোনো কারণ ছাড়াই একজনের জীবনে ভয়াবহ স্থবিরতা এবং অশান্তি ডেকে আনে, তার তালিকা করা হলে সম্ভবত ডিপ্রেশন সবার প্রথমে থাকবে।
শুধু তাই নয়, ডিপ্রেশনের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে নিজেকে শেষ করে দেওয়া বা আত্মহত্যা করা লোকের সংখ্যাও কিন্তু নিতান্তই কম নয়। তবে, ডিপ্রেশনকে অনেকে বিলাসিতা ভেবে বসলেও আদতে এটি মোটেও বিলাসিতা নয়। এমনকি সুনির্দিষ্ট কারণে, সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট ব্যতীতই ডিপ্রেশন নেমে আসতে পারে যেকোনো মানুষের জীবনে। সফল থেকে ব্যর্থ যেকেউ কোনো কারণ ছাড়াই ভুগতে পারেন মানসিক অবসাদগ্রস্ততায়। এর ধারাবাহিকতায় মানসিক ভারসাম্যহীনতা, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া ও সর্বশেষ পরিণতি হিসেবে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন কেউ কেউ। তবে, ডিপ্রেশন কেন হয়, এর সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষণ রয়েছে।
কখনো ভেবেছেন কী, ক্লাসের সবচেয়ে চঞ্চল মেয়েটি হঠাৎই কেন নিশ্চুপ হয়ে যায়? বন্ধুদের আড্ডায় সবসময় মধ্যমণি হয়ে থাকতো যে ছেলেটি, সে কেন ধীরে ধীরে আড্ডা থেকে হারিয়ে যায়? হ্যাঁ, মানসিক আঘাত পেলে মানুষ ডিপ্রেশনে চলে যায়। সিনেমা থেকে শুরু করে বাস্তব জীবনে, এমন কেসগুলোই এখন বেশি দেখবেন। মানসিক আঘাত মানুষকে বিধ্বস্ত করে, তা বিধ্বস্ত করবেই, হয়তো আজ নয়তো কাল, একজন মানুষ মানসিক দিক থেকে যতই শক্তিশালী হোক না কেন। আপনি আপনার বন্ধুকে হাসিচ্ছলে তাচ্ছিল্য করছেন, খোঁটা দিচ্ছেন কিংবা অপমান করছেন। হয়তো আপনার বন্ধু হাসির ছলে তা মেনে নিচ্ছে। কিন্তু তার অবচেতন মন এসব ভুলে যায় না। মনে রাখে। মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে আপনার বন্ধু। আপনার সামান্য মজার জন্য চরম ক্ষতিটা হয় তার।
“Depression is being colorblind and constantly told how colorful the world is.” দার্শনিক এ্যাট্টিকুলাস এর কথাটি হয়তো আমরা অনেকেই শুনিনি। হ্যাঁ, একজন মানুষ যখন ডিপ্রেশনে ভোগে, তখন তার এমনটাই মনে হতে থাকে। সে তার ডিপ্রেশনহীন অতীতে ফিরে যেতে চায় এবং তার কাছে মনে হতে থাকে পুরো পৃথিবী যেন অর্থহীন। তবে তা আগে সুন্দর ছিল।
ডিপ্রেশন কী?
এই ফিচারটি লেখার সময় আমার মাথায় সর্বপ্রথম যে বিষয়টি কাজ করছিল তা হলো ডিপ্রেশন নাকি বিষণ্ণতা, কোন শব্দটি আমি ব্যবহার করবো? যদিও শব্দ দুটি একে অপরের প্রতিশব্দ, তবু আমার মনে হয়েছে বিষণ্ণতা আসলে ডিপ্রেশন শব্দটির মূল যে তাৎপর্য, তা তুলে ধরতে পারে না। বিষণ্ণতাকে আমরা মন খারাপের সাথে তুলনা করতে পারি, ডিপ্রেশন নয়। বস্তুত, আমরা সবাই ডিপ্রেশনে ভুগি এবং এটি এমন একটি বিষয় যে একে এড়িয়ে চলতে চাইলেও তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ডিপ্রেশনের একটি মূল বিষয় হচ্ছে শূন্যতা।
আপনি যখনই অনুভব করবেন আপনার পাশে আসলে কেউ নেই, আপনি বড্ড একা, কেউ আপনার ভালো চায় না বরং আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চায়, তখন বুকের ভেতরে একটা গভীর হাহাকার জেগে উঠবে। শূন্যতা কাজ করবে আপনার চারিদিক ঘিরে। যখন একজন মানুষ দীর্ঘ দিন এই শূন্যতার মাঝে থাকেন, এবং অনুভব করতে সমর্থ হন যে তার জন্য আসলেই কেউ কিছু অনুভব করে না, তখন একজন মানুষ আত্মঘাতী হয়ে ওঠেন। অনেকে বর্তমান যুগের তীব্র কমার্শিয়ালিজম বা কম্পিটিটিভনেস কে ডিপ্রেশনের জন্য দায়ী করে থাকেন।
ডিপ্রেশন যে শুধু বাহ্যিক কারণে হয় তাই নয়। ওষুধ কোম্পানিগুলো মস্তিষ্কের নানারকম কেমিক্যাল ইমব্যালেন্সকে ডিপ্রেশনের জন্য দায়ী করে থাকেন। যদিও, ডিপ্রেশনের প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন এখনও সম্ভব হয়নি। একজন ডিপ্রেসড মানুষের শরীরে ঠিক সেই কেমিক্যাল ব্যালেন্সই থাকে, যা একজন সুস্থ মানুষের শরীরে থাকে। তারপরও, ডিপ্রেশনে আক্রান্ত মানুষ কীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, হারিয়ে ফেলেন তাদের স্বাভাবিক জীবনের গতিধারা?
এর উত্তর হয়তো একটা আছে। যারা ডিপ্রেসড নন, তারা সাধারণত জীবনের সমস্যাগুলোকে একটি নির্দিষ্ট ফিল্টারে মেপে নেন। প্রতিটি সমস্যার একটি সুনির্দিষ্ট সমাধান প্যাটার্ন আছে। সেই সূত্র ধরে তাঁরা এগিয়ে যান এবং এর ফলে সমস্যা সমাধানের পর তাদের ধারে কাছেও ডিপ্রেশন ঘেঁষতে পারে না। কিন্তু কি হয় যখন একজন ব্যক্তি বারবার তার সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হন?
একজন মানুষ তীব্র ডিপ্রেশনে ভুগলে তার জীবনে শুরু হয় দোটানার। দ্বৈত সত্ত্বা একা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়। এই দ্বৈত সত্ত্বার একটি সত্ত্বা হচ্ছে পুরোপুরি অভিনয়, যেখানে নিয়তই তাকে হাসি-খুশি, প্রাণোচ্ছ্বল বা কর্মক্ষম দেখাতে হয়। কিন্তু অপর যে সত্ত্বাটি, যেটি কিনা তার আসল সত্ত্বা, তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। ভেতর থেকে নিংড়ে নেয় সবকিছুর সার্থকতা। একসময়, দুটি সত্ত্বার ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হন ব্যক্তিটি। তখন, পুরোপুরিভাবে ডিপ্রেশনের হাতে সোপর্দ করতে হয় নিজেকে।
আমাদের সমাজ কী ভাবে ডিপ্রেশন নিয়ে?
‘তোমার মতো বয়সে আমরা কতো সংগ্রাম করে বড় হয়েছি, অথচ তুমি সবকিছু পেয়েও পারছো না। সমস্যা কী তোমার?’ এরকম কথা আমাদের সবাইকেই প্রায়ই শুনতে হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এ কথাগুলো এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করলেও মানসিকভাবে আঘাত করে থাকে অবচেতন মনে। ফলে অজান্তেই দেহমনের উপর অবসাদ জায়গা করে নেয়। ‘তার জীবনে কত কষ্ট, এত কষ্ট করেও সে কীভাবে সফল হচ্ছে? তুমি কেন এত সুযোগ সুবিধা পেয়েও পারছো না?’ অনেকে আবার সরাসরি বলে বসেন, ডিপ্রেশন তো শৌখিনতা। ‘অমুক রিকশাওয়ালার জীবনে তো কোনো ডিপ্রেশন নেই, তোমার এত ডিপ্রেশন কেন?’
এ ধরনের কথাবার্তাগুলো শুনতে বেশ শাসনমূলক শোনালেও মূলত অজ্ঞতাপ্রসূত, ফলাফল হিসেবে ভয়ংকর পরিণতি টেনে আনে। উস্কে দেয় ডিপ্রেশনকেই। জাজমেন্টাল হয়ে একজনের সাথে আরেক জনের পরিস্থিতিকে তুলনা করে তাকে হীনমন্যতায় ভোগানো, কখনো একজন ডিপ্রেশনে ভোগা ব্যক্তিকে তার অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে না।
সমাজে সব মানুষ একই রকম সংগ্রাম করতে জানে না। সবার জন্য তা সম্ভবও নয়। একজন ডিপ্রেশনে ভোগা ব্যক্তিকে আরেক জনের সাথে তুলনা দিয়ে হীনমন্য করা মানে হচ্ছে তার ডিপ্রেশনকে আরও এক ধাপ উস্কে দেওয়া। জীবনে খাওয়া পড়ার চিন্তাটাই মূল চিন্তা নয়। যদি তাই হতো, তবে যাদের সবকিছু আছে তাদের মাঝে ডিপ্রেশন রোগ এত বেশি দেখা দিতো না। অথচ ডিপ্রেশনে এই শ্রেণির লোকেদেরই বেশি ভুগতে দেখা যায়। একজন ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তি একজন মানসিক রোগী। আমার আপনার কাছে তার কষ্ট মেকি মনে হতে পারে, কিন্তু একমাত্র ভুক্তভোগী বুঝতে পারে কি পাথর তাকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আপনি যে ফিল্টারে দুনিয়াকে মাপেন, তা তার কাছে নেই। সুতরাং চটজলদি কোন সিদ্ধান্ত যা আপনার জন্য কাজ করে, তা তার জন্যও ফলবে এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই।
সমস্যা হচ্ছে আমাদের সমাজের। অন্যান্য মানসিক রোগকে যেমন সিজোফ্রেনিয়া, হিস্টিরিয়া প্রভৃতি রোগকে মানসিক রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও ডিপ্রেশনকে তারা রোগের কাতারে ফেলতে নারাজ। সমাজে কিছু শিক্ষিত ব্যক্তি আছেন যারা এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করে রোগীর সাথে সঠিক আচরণটি করতে জানেন, কিন্তু অধিকাংশই এ ব্যাপারে নিষ্ঠুর রকমের অজ্ঞ। ডিপ্রেশন এক গভীর অসুখ, যা আপনি হয়ত নিজেই বয়ে চলেছেন কিন্তু বুঝতে পারছেন না।
সাধারণ যে কোন রোগীকে মানুষ সহানুভূতি দেখাতে চাইলেও ডিপ্রেশনের রোগী যেন রোগী নয়। বরং চারপাশে ইনিয়ে বিনিয়ে তাদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ, তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের স্বীকার হতে হয়। খোঁজ নিয়ে দেখেন, আমরা যাদের কথায় কথায় ‘অসামাজিক’, ‘অলস’, “বদরাগী’, ঘরকুনো, আধা পাগল বলে থাকি তাদের অধিকাংশই গুরুতর কোনো কারণে ডিপ্রেশনের শিকার।
ডিপ্রেশনের রোগীদের সাথে আমাদের কেমন আচরণ করা উচিৎ?
ইংরেজীতে একটা কথা আছে, ইম্প্যাথেটিক (empathetic) যাকে বাংলা করলে দাঁড়ায় সমানুভূতিশীল। সহানুভূতিশীল নয় কিন্তু। সমানুভূতিশীল হচ্ছে সেই অনুভূতি অনুভব করার চেষ্টা করা, যার মাঝ দিয়ে ভুক্তভোগী সময় পার করছেন। সহানুভূতি বলতে করুণা করা বোঝায়। আপনি নিজেকে একজন ডিপ্রেশনে ভোগা রোগীর জায়গায় কল্পনা করুন। সে কি অবস্থায় আছে সে অবস্থাটুকু নিজের করে ভাবুন। সম্পূর্ণভাবে জাজমেন্টবিহীন অবস্তানে নিজেকে দাঁড়া করান। তার পাশে থাকুন। সবচেয়ে কার্যকর উপায়, তার সাথে প্রচুর কথা বলুন, তাকে কথা বলতে দিন, কথা বলতে বলতে সে আপনাকে অনেক কিছুই বলে দেবে, যা এতদিন তার মাঝে ডিপ্রেশনকে উস্কে দিচ্ছিল। আরেকটি বিষয়, ডিপ্রেশনের রোগীকে একা থাকতে দেওয়া উচিৎ নয়। নিয়মিত বাইরে যেতে, ব্যায়াম, ফুলের বাগান, খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করা, হাসি কৌতুকের মাঝে থাকলে ধীরে ধীরে ডিপ্রেশন কেটে যেতে পারে। কখনও কখনও বিপরীত লিঙ্গের কারও সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠলেও ডিপ্রেশন থেকে মেলে মুক্তি।
ডিপ্রেশন একবার কেটে গেলে আবারও আসতে পারে। তাই সতর্ক থাকতে হবে। অহেতুক প্রতিযোগিতাপ্রবণ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আজকের সমাজে বেশিরভাগ মানুষের ডিপ্রেশনের মূল কারণ অন্যের অর্জন এবং তা সামাজিক মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত প্রচারকরণ। শুধু অর্জনই নয়, নানারকম আকার ইঙ্গিতমূলক পোস্টে অপরকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করাও ডিপ্রেশনের জন্য দায়ী। এ ধরনের বিষাক্ত মানুষদের থেকে দূরে সরে আসতে হবে। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার সীমিত করে ফেলতে হবে, পরিবার ও বাস্তব জীবনের বন্ধুদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।