পৃথিবীর অনেক দেশে যখন প্রতিদিন হাজার হাজার করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ছে, তখন জুন মাসের শেষ দিকে নিউজিল্যান্ডে মাত্র করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিশ্চিত হয়েছিল দুই জনের।
শুধু তাই নয়, তার আগের ২৪ দিন নিউজিল্যান্ডে একজনেরও করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়েনি।
ফলে, দুজনের সংক্রমণ ধরা পড়ার যখন জানা গেল যে কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম ভঙ্গের জন্যই এটা ঘটেছে – তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হলো।
প্রশ্ন হচ্ছে, নিউজিল্যান্ড কোভিড-১৯ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এত সফল হলো কীভাবে?
নিউজিল্যান্ড কখন সীমান্ত বন্ধ করেছিল?
ফেব্রুয়ারি মাসের দুই তারিখ চীনের বাইরে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে ফিলিপাইনে। সে সময় নিউজিল্যান্ডে তখন কোন কোভিড সংক্রমণের খবরই ছিল না। কিন্তু তার পর দিন থেকেই চীন থেকে বা চীন হয়ে আসা সব বিদেশীর প্রবেশ নিষিদ্ধ করে নিউজিল্যান্ড।
পাশাপাশি নিউজিল্যান্ডের কোন নাগরিক চীন থেকে দেশে ফিরলেই তাকে ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকতে হতো।
যখন সারা দুনিয়া জুড়ে ভাইরাস ছড়াতে লাগলো – তখন ইরানের সাথেও বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করা হলো। কারণ ইরানই ছিল নিউজিল্যান্ডের প্রথম করোনাভাইরাস কেসের উৎস।
এর পর একে একে উত্তর ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আসা যাত্রী এবং সংক্রমণ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে এমন যে কারো ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি হলো।
এর পর মার্চের ১৬ তারিখ থেকে নিউজিল্যান্ডে আগমনকারী নাগরিক-অনাগরিক নির্বিশেষে সবার জন্য দেশটিতে অবতরণের পর আইসোলেশন বাধ্যতামূলক করা হলো।
এর ব্যতিক্রম ছিল শুধু প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর লোকেরা – যেখানে করোনাভাইরাস প্রায় ছড়ায়নি বলা যায়।
প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন বলেছিলেন, এটা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে কঠোর বিধিনিষেধ – যে জন্য তিনি কারো কাছে দু:খ প্রকাশ করবেন না।
এরও কয়েকদিন পর মিজ আরডার্ন এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ নিলেন । তিনি নিউজিল্যান্ডের নাগরিক নন, বা বাসিন্দা নন – এরকম প্রায় সবার জন্যই দেশটির সীমান্ত বন্ধ করে দিলেন।
“যখন সারা বিশ্বে সংক্রমণ ছিল মাত্র কয়েক হাজার – সে সময়ই এমন পদক্ষেপ নেবার ফলে নিউজিল্যান্ডের পক্ষে দেশের জনগণের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছিল” – বিবিসিকে বলছিলেন অধ্যাপক মার্টিন বেরকা, নিউজিল্যান্ডের ম্যাসি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অর্থনীতিবিদ।
আগেভাগে লকডাউন, এবং ভাইরাস নির্মূলের পরিকল্পনা
মার্চ মাসের মাঝামাঝি এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে সাধারণ ফ্লু মহামারির কর্মপরিকল্পনা দিয়ে এই নতুন করোনাভাইরাস ঠেকানো যাবে না – বলছিলেন নিউজিল্যান্ডে শীর্ষস্থানীয় সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মাইকেল বেকার।
চীনের উহান শহরের লকডাউনের সাফল্যের ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক রিপোর্টে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে নিউজিল্যান্ডকে শুরু থেকেই সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিতে হবে এবং তার উদ্দেশ্য হতে হবে ভাইরাসটি একেবারে উচ্ছেদ করা – বলেন অধ্যাপক বেকার।
মার্চের শেষ দিকে জনগণকে দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করতে আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়। নিউজিল্যান্ডে জারি করা হয় চার-স্তর বিশিষ্ট এক সতর্কতা ব্যবস্থা।
মার্চ মাসের ২৫ তারিখ এই হুঁশিয়ারি চতুর্থ স্তরে উন্নীত করা হয়। এর আওতায় জারি করা হয় দেশব্যাপি এক সার্বিক লকডাউন, সবাইকে বাড়িতে থাকতে বলা হয়। চালু থাকে শুধুমাত্র জরুরি সেবাসমূহ।
“অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত”
ওই সময় নিউজিল্যান্ডে মাত্র ১০২ জনের সংক্রমণ রেকর্ড করা হয়েছিল। তখনো কেউ মারা যায়নি।
তুলনামূলকভাবে ওই সময় যুক্তরাজ্যে ৬,৫০০ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন, এবং মারা গিয়েছিলেন ৩৩০ জন।
যুক্তরাজ্য কখনো তার সীমান্ত বন্ধ করেনি। তবে জুন মাসের প্রথম দিকে সকল আগমনকারী যাত্রীকে বাধ্যতামূলক আইসোলেশনে থাকতে হবে বলে নিয়ম করেছিল। জুলাই মাসের প্রথম দিকে কিছু দেশের জন্য সেই নিয়ম আবার তুরে নেয়া হয়।
যুক্তরাজ্য সরকারের বক্তব্য ছিল যে তারা “বৈজ্ঞানিক পরামর্শের ভিত্তিতে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ” নিচ্ছিল। তা ছাড়া যেহেতু যুক্তরাজ্যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ ততদিনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল তাই সীমান্তে বিধিনিষেধ আরোপ করলে তার প্রভাব হতো খুবই সীমিত।
অধ্যাপক বেরকা বলছিলেন, “ব্রিটিশদের মত আমরা যদি বেশি সময় অপেক্ষা করতাম এবং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সবকিছু খোলা রাখতাম – তাহলেএটা বিরাট সমস্যার পরিণত হতো। আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা হয়তো অন্য কিছু দেশের তুলনায় সামান্য বেশি হয়েছে কিন্তু এর ফল হয়েছে এই যে আমরা বিচ্ছিন্ন হলেও মুক্ত এবং স্বাস্থ্যসম্মতভাবে চলতে পারছি।
“অধ্যাপক বেকার বলছেন, লকডাউন কার্যকর করার ক্ষেত্রে নিউজিল্যান্ড দারুণ কাজ করেছে। সংক্রমণ যখন শীর্ষে তখনও নিউজিল্যান্ডে দৈনিক সংক্রমিতের সংখ্যা ছিল মাত্র ৮৯ জন।
তারা দেশবাসীকে তাদের আহ্বানে মনপ্রাণ দিয়ে সাড়া দেয়াতে পেরেছে – বলছিলেন তিনি।
টেস্ট আর কনট্যাক্ট ট্রেসিং
লকডাউনের সময় ব্যাপকভাবে টেস্ট ও কনট্যাক্ট ট্রেসিংএর এক কর্মসূচি কার্যকর করা হয়।
নিউজিল্যান্ড এখন প্রতিদিন ১০,০০০ টেস্ট করাতে পারছে, এবং কোন সংক্রমিত ব্যক্তি চিহ্নিত হবার সাথে সাথে তার সংস্পর্শে আসা লোকদের আইসোলেশনে যাবার নির্দেশ দিচ্ছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নিউজিল্যান্ডের প্রশংসা করে তাদেরকে অন্য দেশের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেছে।
নিউজিল্যান্ডের যে সমালোচনা হয়নি তা অবশ্য নয়।
লকডাউন চলতে থাকার ফলে প্রথমদিকে যে রাজনৈতিক ঐকমত্য ছিল তাতে চিড় ধরতে শুরু করে।
তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা সাইমন ব্রিজেস লকডাউনের ফলে অর্থনীতি এবং মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির কথা তুলে ধরে বলেন, এ ক্ষতি লকডাউন না থাকলে যে ক্ষতি হতো তার চেয়ে বেশি।
লকডাউনের অর্থনৈতিক ক্ষতি নিয়ে মানুষের মধ্যে থেকেও প্রশ্ন উঠেছে।
তবে লকডাউন ভাঙার জন্য পুলিশ যে শত শত লোককে অভিযুক্ত করে – তা প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন ৮০ শতাংশ লোকই।
এ সাফল্য কি ধরে রাখা যাবে?
জুন মাসের ৮ তারিখ জাসিন্ডা আরডার্ন ঘোষণা করলেন, ১৭ দিন ধরে জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোন সংক্রমণ হয় নি এবং আক্রান্ত সবাই পুরোপুরি সেরে উঠেছেন – ফলে আপাতত নিউজিল্যান্ড ভাইরাস ছড়ানো থামাতে পেরেছে।
লকডাউন তুলে নেয়া হলো। প্রাত্যহিক জীবন এখন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, যদিও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কিছু নিয়ম এখনো বলবৎ আছে।
কিন্তু বিদেশীদের জন্য সীমান্ত এখনো বন্ধ। কবে খোলা হবে তার কোনো ইঙ্গিত নেই। কর্মকর্তারা বলছেন, এ ক্ষেত্রে আত্মসন্তুষ্টি বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এক সপ্তাহ পরই এর সত্যতা বোঝা গেল।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য থেকে আসা দুজন মহিলা করোনাভাইরাস পজিটিভ বলে চিহ্নিত হলেন। তাদের পরীক্ষা না করেই কোয়ারেন্টিন থেকে আগে আগে বাইরে বেরুনোর অনুমতি দেয়া হয়েছিল, এবং তারা অসুস্থ হবর আগে পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে সারা দেশ ঘুরেছিলেন।
এর পর জানা যায়, বেশ কিছু লোককে উপযুক্ত পরীক্ষা ছাড়াই কোয়ারেন্টিন থেকে বেরুনোর অনুমতি দেয়া হয়েছিল – যা সরকারের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার শামিল।
যদিও এর ফলে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়েনি, কিন্তু ব্যাপক জনরোষের মুখে স্বাস্থ্য মন্ত্রী ডেভিড ক্লার্ককে পদত্যাগ করতে হয়।
অধ্যাপক বেকার বলেন, নিউজিল্যান্ড একটি প্রত্যন্ত এবং ছোট দেশ বলে অর্থনৈতিক মূল্য স্বাভাবিকভাবেই হবে অত্যন্ত চড়া। কারণ সরকারি ভর্তুকি একসময় শেষ হযে যাবে এবং দেশটির বিদেশী পর্যটক ও কর্মী দরকার।
নিউজিল্যান্ড ছোট দেশ বলেই তারা সফল হতে পেরেছে, তাই নয় কি?
অধ্যাপক বেকার বলছেন, নিউজিল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতা আর কম ঘনত্বের জনসংখ্যা তাদের জন্য সহায়ক হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কার্যকর সরকার ও অবকাঠামো থাকলে এটা সব দেশেই করা সম্ভব – যেমন ভিয়েতনাম, তাইওয়ান ও চীন।
“বরং যে দেশগুলোর অবস্থা আমাকে অবাক করেছে তারা হলো যুক্তরাজ্য, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা। সাধারণত জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আমরা তাদেরকেই নেতৃত্বে ভুমিকায় দেখি।“
তবে যুক্তরাজ্য সরকার সবসময়ই বলেছে যে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে তাদের কৌশল বৈজ্ঞানিক নির্দেশনাই অনুসরণ করেছে।
সূত্র : বিবিসি