সমাপ্ত অর্থবছরে (২০১৯-২০) রাজস্ব আদায়ের বিশাল অংকের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আদায়ে মূল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। বিদায়ী বছরে এনবিআর ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ১১ মাসে (জুলাই-মে) এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের হিসাব প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, ১১ মাসে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। জুন মাসে সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায় হয়েছে বলে এনবিআরের একটি সূত্র জানিয়েছে। এতে নতুন অর্থবছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে সাড়ে ৫৩ শতাংশ বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে এনবিআরকে। অর্থনীতিবিদরা এ লক্ষ্য অর্জনের চিন্তা করারও কোনো সুযোগ নেই বলে উল্লেখ করেছেন।
এনবিআরের একটি সূত্র জানিয়েছে, করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে লকডাউন খোলার পর মে মাসের চেয়ে জুন মাসে বেশি রাজস্ব আদায় হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আদায় অনেক পিছিয়ে আছে। গত মে মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। আর বিদায়ী অর্থবছরে প্রকৃত রাজস্ব আদায়ের সাথে চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা অর্জন করতে হলে প্রায় ৫৪ শতাংশ রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, নতুন অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ অসম্ভব হবে। আর রাজস্ব আদায়ের বিশাল ঘাটতি পূরণ করতে হলে সরকারের ব্যয় সঙ্কোচন করতে হবে। অন্যথায় বিশাল অংকের ঘাটতি বাজেট অর্থায়নের জন্য ব্যাংক খাতের ওপর সরকারের বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল হতে হবে। এতে বেসরকারি খাত আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গতকাল জানিয়েছেন, ‘আমি শুরু থেকেই বলে আসছি, নতুন অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা। এ লক্ষ্যমাত্রা কোনোভাবেই পূরণ হবে না।’ কারণ করোনার প্রাদুর্ভাবে দেশে চলমান পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হয় তা কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে বিদায়ী বছরের মতো চলতি অর্থবছরেও রাজস্ব আদায়ের বিশাল অংকের ঘাটতি হবে। এতে বেড়ে যাবে বাজেট ঘাটতি। এ বাজেট ঘাটতি কমাতে সরকারের ব্যয় কমাতে হবে। ইতোমধ্যেই সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন নতুন গাড়ি কেনা যাবে না। বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রেও কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার কমে যাবে। তবে রাজস্ব ব্যয়ে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হবে না। আর তা না হলে সরকারের ব্যাংক খাত থেকেই বেশি মাত্রায় ঋণ নিতে হবে। চলতি অর্থবছরে এমনিতেই ব্যাংক খাত থেকে বিশাল অংকের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বেসরকারি খাত চাপে পড়ে যাবে। রাজস্ব ঘাটতির কারণে ব্যাংক খাত থেকে আরো বেশি মাত্রায় ঋণ নিলে বেসরকারি বিনিয়োগ বড় আকারে বাধাগ্রস্ত হবে। বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়লে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনও বাধাগ্রস্ত হবে বলে তিনি মনে করেন। এমনি পরিস্থিতিতে সরকারের যতটুকু সম্ভব অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিউিটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর এ বিষয়ে গতকাল জানিয়েছেন, গেল অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এ ঘাটতি কম করে হলেও ৮০ হাজার কোটি টাকা থেকে এক লাখ কোটি টাকা ছেড়ে যেতে পারে। এ বিশাল ঘাটতি সমন্বয় করতে হলে সরকারের ব্যয় কমাতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার কমে যাবে। তবে সরকারের রাজস্ব ব্যয়ের তেমন কোনো হেরফের হবে না। তিনি মনে করেন, সরকারের রাজস্ব ব্যয় কিছুটা হলেও কমানো উচিত। বেতনভাতা কমানোর নিয়ম থাকা উচিত। অন্যথায় সরকারের ব্যাংক ঋণের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হতে হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক পরিসংখ্যান মতে, আগের অর্থবছরের মে মাসের চেয়ে বিদায়ী অর্থবছরের মে মাসে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক প্রায় ৩৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের মে মাসে রাজস্ব আাদায় হয়েছে ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের মে মাসে ছিল ২০ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা। এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চলতি অর্থবছর শেষে এনবিআরের রাজস্ব সংগ্রহ হয়েছে দুই লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। এতে ঘাটতি হয়েছে মূল লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা থেকে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তিন লাখ ৩০ হাাজর কোটি টাকা। বিশ্লেষকদের মতে, এ বিশাল অংকের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। কারণ, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের কলকারখানার চাকা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বেসরকারি অফিস চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কর্মকর্তাদের বেতনভাতা কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। অনেকেই হচ্ছেন চাকরিচ্যুত। এমনি পরিস্থিতিতে রাজস্ব আদায়ের কমে যাওয়ার ধারাবহিকতায় খুব বেশি একটা উন্নত হবে না।
এ দিকে করোনার প্রভাবে আমদানি-রফতানিতেও ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত মে মাসে পণ্য আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ৩১ শতাংশের ওপরে। আমদানির সাথে রফতানি আয়ও ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক প্রায় ১৭ শতাংশ। চলমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে এনবিআরের রাজস্ব সংগ্রহ বড় ধরনের পরিবর্তন হবে না। আর এতে বাজেট ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে। ব্যয় ঠিক রাখতে হলে এ ঘাটতি বাজেট অর্থায়নে ব্যাংক খাত থেকে অধিক মাত্রায় ঋণ নিতে হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেসরকারি খাত। ইতোমধ্যেই বেসরকারি বিনিয়োগ কমে গেছে। এতে চলতি অর্থবছর শেষে কাক্সিক্ষত হারে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে তারা মনে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সূত্র: নয়া দিগন্ত