তৈরী পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের অসতর্কতার কারণে শ্রমঘন এ শিল্প খাতে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক ক্রমেই বাড়ছে। ঢাকার সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বেশ কিছু কারখানায় দিনরাত কাজ চলছে। মালিকপক্ষের চাপে ঝুঁকি নিয়ে দলবদ্ধ হয়ে এসব কারখানায় কাজ করছেন অনেক শ্রমিক। সরকারের নির্লিপ্ততা এবং বিজিএমইএ-বিকেএমইএর আশ্রয়ে করোনা ঝুঁকির মধ্যেই নতুন করে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে অনেক বন্ধ কারখানাও। সরকারঘোষিত প্রণোদনার অর্থ গ্রহণ করতে চলছে নানামুখী তোড়জোড়। এ কারণে সাধারণ ছুটিতে ঢাকার বাইরে যাওয়া শ্রমিকদের অনেকে বাধ্য হয়ে রাজধানীমুখী হচ্ছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এসব কারণে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের তৈরী পোশাক শিল্পখাতে সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বিভিন্ন পর্যায়ের গার্মেন্ট শ্রমিক, কারখানার মালিক এবং বিজিএমইএ নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, করোনাভাইরাস ছড়ানোর হাত থেকে রক্ষায় ২৫ মার্চের পর থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে দেশবাসীকে নিজ নিজ অবস্থানে ঘরবন্দী থাকার নির্দেশ দেয়া হলেও জরুরি অর্ডার কিংবা করোনাসংক্রান্ত ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম তৈরি হচ্ছে বলে অনেক কারখানায় ছুটি দেয়া হয়নি। মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএর পক্ষ থেকে তখন সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা না দিয়ে কারখানার মালিকদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ ছুটির বিষয়ে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ এবং প্রণোদনার অর্থ শ্রমিকদের ব্যক্তিগত হিসাবে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশনা আসার পর নড়েচড়ে বসেন এসব কারখানার শ্রমিকরা। উৎপাদন বন্ধ থাকা কারখানাগুলোর শ্রমিকদের ন্যায় তারাও কাজ না করে বেতন পাওয়ার বিষয়টিতে জোর দিতে থাকেন। এ প্রক্রিয়ায় শ্রমিকদের চাপের মুখে কিছু কারখানার মালিক উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, করোনার অযুহাতে সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা আদায়ে অর্ডার বাতিল হওয়া নিয়ে গণমাধ্যমে কিছু অতিরঞ্জিত তথ্য উপস্থাপন করে বিজিএমইএ। স্বাভাবিক কারণেই প্রণোদনার প্যাকেজ পাওয়ার পর একের পর এক বাতিল হওয়া অর্ডার ফিরে পাওয়ার ঘোষণা আসতে থাকে তাদেরই কাছ থেকে। যদিও প্রণোদনার টাকা অনুদান হিসেবে না দিয়ে ঋণ হিসেবে দেয়া হচ্ছে এবং ঘোষিত তহবিল সম্ভাব্য ক্ষতির একেবারেই সামান্য অংশ। তারপরও ঋণ পাওয়ার জন্য নিজেদের যোগ্য করে তুলতে অতিশয় তৎপর হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তারা। এর আগের তিন মাসের বেতন পরিশোধিত থাকা এবং সরাসরি শ্রমিকদের অ্যাকাউন্টে বেতনের টাকা পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তারা।
এ দিকে সাধারণ ছুটি ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত করার মাধ্যমে করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়েছে। শ্রমিকের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে কারখানা চালু রাখতে পারা সংক্রান্ত সরকারের ঘোষণাকে কাজে লাগাচ্ছেন মালিকরা। অধিকাংশ বন্ধ কারখানার মালিক উদ্যোগ নেন নিজ কারখানা চালু করার। এ জন্য অনেক কারখানা শ্রমিকদের বেতন দেয়া হবে বলে ডেকে আনছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এতে করোনা ঝুঁকি বৃদ্ধির পাশাপাশি ছুটিতে ঢাকার বাইরে চলে যাওয়া শ্রমিকরা পড়েছেন চরম বিপদে। ঢাকার বাইরে থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হেঁটে, সাইকেল চালিয়ে, রিকশায় করে কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা দেয়ার সংবাদ আসছে গণমাধ্যমে। যদিও বিজিএমইএ-বিকেএমইএ নেতাদের দাবি, শ্রমিকরা তো ঢাকাতেই আছে। তাদের ছুটি দেয়ার সময় কর্মস্থলের আশপাশে থাকতে বলা হয়েছে। তারা বাইরে গেলেন কেন?
অভিযোগ রয়েছে, দেশের রফতানি আয়ে ৮০ শতাংশের বেশি অবদান রক্ষাকারী তৈরী পোশাক শিল্পখাতের উদ্যোক্তারা করোনার বিষয়টিকে বরাবরই কম গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। বিজিএমইএ-বিকেএমইএ এখনো কারখানা চালু রাখার পক্ষে। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হকের স্পষ্ট বক্তব্য, কারখানা বন্ধ করা বিজিএমইএর কাজ নয়। আর বিকেএমইএ সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান এমপি তার সদস্যদের জানিয়ে দিয়েছেন, যেকোনো সদস্য চাইলে শ্রমিকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা দিয়ে কারখানা চালু রাখতে পারবেন। গত ২ এপ্রিল সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া এক চিঠিতে তিনি বলেন, ৪ এপ্রিলের পর থেকে আপনি আপনার কারখানাটি পরিচালনা করবেন কি না তা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। যদি কারখানা পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তবে সে ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে আপনার শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের রক্ষা করার জন্য সব স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে কারখানা পরিচালনা করতে হবে।
যদিও সাধারণ ছুটির মধ্যে কারখানা খোলার সংবাদে ক্ষুব্ধ এসব কারখানার শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গাজীপুরের একটি কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজার (পিএম) বলেন, শ্রমিকদের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব না দিয়েই অনেক ফ্যাক্টরি খুলছে। চৈত্রের তপ্ত দুপুরে শত শত মানুষ ময়মনসিংহ রোড ধরে হেঁটে আসছেন ঢাকায়। কোলে শিশু, কাঁধে ব্যাগ। দীর্ঘ লাইন। নারী, পুরুষ, শিশু, বয়স্ক বাবা-মা। তারা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন, শ্রমিকের সন্তান বা বাবা-মা। তাদের অনেকরই এখনো বেতন হয়নি। কাজে যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না। টিভি চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে তারা বলছেন, ‘না খেয়ে মরতেই হবে। না হয় করোনায় মরলাম! তবু তো মরার আগে বাঁচার চেষ্টা করলাম।’ তিনি বলেন, শ্রমিকের বাঁচার চেষ্টা মানে হোম কোয়ারেন্টিন না। শ্রমিকের বাঁচার চেষ্টা মানে চাকরি না হারানোর চেষ্টা করা। শিশুসন্তানের খাবার সন্ধানে অর্থ জোগাড় করা। করোনা থেকে বেঁচে গেলেও চাকরি না থাকলে কেমন করে সে বাঁচবে, কেমন করে বাঁচাবে তার কোলের শিশুসন্তানের জীবন!
এ দিকে সাধারণ ছুটির মধ্যে কারখানা চালুর উদ্যোগে কাজে যোগদানে আগ্রহী শ্রমিকদের দুর্দশা দিয়ে গতকাল একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ময়মনসিংহ প্রতিনিধির পাঠানো ওই রিপোর্টে বলা হয়, দেশে গণপরিবহন বন্ধের মধ্যে শনিবার কিছু গার্মেন্ট কারখানা খোলার কথা থাকায় ময়মনসিংহ থেকে হেঁটে ১১২ কিলোমিটার দূরের ঢাকার পথে রওনা হয়েছেন হাজারো শ্রমিক। শুক্রবার সকাল থেকে ময়মনসিংহ ব্রিজের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় হাজারো গার্মেন্ট শ্রমিককে ঢাকার দিকে হেঁটে যেতে দেখা যায়। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে লকডাউনের মধ্যে ট্রেন-বাসসহ সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ থাকায় নিজের দু’টি পা ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পাননি তারাÑ তার ওপর ভরসা করেই পাড়ি দিতে নেমেছেন দীর্ঘপথ।
ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনা জেলার দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটারের বেশি। কখনো রিকশায় কখনো হেঁটে ময়মনসিংহ পর্যন্ত এসেছেন খলিল আহম্মেদ। গাজীপুরের পিএন গার্মেন্টস কর্মী খলিল বলেন, ‘ফজরের নামাজের পর নেত্রকোনার ইসলামপুর থেকে রওনা দিয়েছি। রাস্তায় গাড়ি তো নাই, রিকশাও চলছে হালকা হালকা। তাই কিছুক্ষণ রিকশায় চড়ে আর কিছুক্ষণ হেঁটেই চলছি। পোশাক কারখানায় কাজ করেই তাদের পরিবারের সদস্যদের খাবার জোটাতে হয়। কাল গার্মেন্টে হাজিরা না দিতে পারলে চাকরি থাকবে না। কাল-পরশু বেতনও হবে, তাও পাওয়া যাবে না, তাই হেঁটেই ঢাকা যেতেই হবে।
ময়মনসিংহ থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে শেরপুর জেলা। সেখান থেকে চাকরি বাঁচাতে আসছেন ইউসুফ আলী। নারায়ণগঞ্জের অনন্ত গ্রুপের শ্রমিক ইউসুফ আলী বলেন, শেরপুর থেকে অনেক কষ্ট করে ময়মনসিংহ পর্যন্ত আসলাম। এখন নারায়ণগঞ্জে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। সময় মতো না যেতে পারলে বেতনও তুলতে পারব না।